রাবেয়া জাহান আভা: হালকা শীতের আলস্যমাখা সকালে যখন আমার ছেলেটা স্কুলে যেতে আলসেমি করে তখন মনে হয় আমিই চলে যাই। ওদের পড়াশোনার প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে ভীষণ আনন্দ দেয়। মনে হয় শৈশব ফিরে পেয়ে এই স্কুলটিতে যদি আমি পড়তে পারতাম, আর যাই হোক পাঠ্যবইগুলো অন্তত আনন্দ নিয়ে পড়তাম।
ছেলেটাকে মাঝে মাঝেই বলি, “তুমি তো স্কুলে যাও খেলতে, টিফিন খেতে আর লাঞ্চ করতে”। আসলেই তাই। আমি ছেলেটার ব্যাগে শুধু ওর জন্য অল্প কিছু স্ন্যাকস আর বোতলভর্তি পানি দিই। আর খেলা শেষে ঘাম মোছার জন্য একটা তোয়ালে। গত বছর আমরা যখন ওকে সেশনের মাঝামাঝি ভর্তি করিয়েছিলাম, স্কুলে খাপ খাওয়ানো নিয়ে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকলেও শিক্ষকরা আমাদের বারবারই আশ্বস্ত করেছেন।
ভাষা, বন্ধু, শিক্ষক সর্বোপরি পাঠ্যবইয়ের সাথে খাপ খাওয়ানোটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বাচ্চাদের জন্য। কিন্তু আমরা শুধু টেনশনই করেছি। বাকি যা করার, ওর শিক্ষকই করেছেন। ফিলিপিনো এই শিক্ষকটির প্রতি আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। উনি বারবার একটি কথাই বলেছেন, বাচ্চাকে বাসায় পড়ার জন্য কোনো চাপ দেবেন না, যা করার আমিই করবো। বাড়তি ক্লাস নিয়ে তিনিই আমার ছেলেসহ কয়েক বাচ্চাকে তৈরি করেছেন, যাতে ক্লাসের অন্য বাচ্চার চেয়ে পিছিয়ে না পড়ে, ক্লাসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সবার সাথে।
আসলে পড়া তেমন না থাকলেও পড়ার প্রতি যে আনন্দ তা তিনিই তৈরি করে দিয়েছেন। এখন এক বছর পরে এসে ওর হোমওয়ার্ক বা পড়া নিয়েও আমাদের তেমন চিন্তা করতে হয় না। যেটা হোমওয়ার্ক দেয়, সেটা শিক্ষক আগেই ক্লাসে কয়েকবার করিয়ে নেন। কাজেই ও প্রতিটি বিষয়ই শেখে আনন্দ নিয়ে। বরং অনেক কিছুই আমাদের শেখায়। ভর্তির সময় যে বই, খাতা, কলম কিনতে হয়েছে ওর জন্য, তা মূলত জমা থাকে স্কুলে।
ক্লাস ওয়ানের একটা বাচ্চাকে কী যত্ন নিয়ে যে ভাষা, সামাজিক শিক্ষা, আর্ট, বই পড়া, হাতের লেখা, বিজ্ঞান, অংক শেখানো হয়, তাতে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। এসবগুলো প্রতিদিন নয়, বরং সপ্তাহের এক একটি দিনে যাতে বাচ্চারা একই বিষয় পড়তে পড়তে বিরক্ত না হয়। সব বিষয়ের জন্যই থাকে আলাদা শিক্ষক। সপ্তাহের একটি নির্দ্দিষ্ট দিন নির্দ্দিষ্ট শিক্ষক দিয়ে থাকে ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ ক্লাস। এতে খেলা মূল হলেও, শারীরিক শিক্ষার নানা বিষয় শেখানো হয়। এই ছোট ক্লাসেই ওরা ফিল্ড ভিজিটে যায়। শ্রেণীকক্ষ থেকেই শেখে কিভাবে গাছ লাগাতে হয়, গাছের যত্ন নিতে হয়, যা কাজে লাগায় স্কুলের গণ্ডির ভেতরেই। সবই করছে ওরা আনন্দ নিয়ে।
আমি জানি দেশে গেলে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে। দেশে আমার ছেলেটাকে যখন ভর্তি করিয়েছিলাম তখন কোনো পড়া নেই বললেও আমাদের রীতিমতো চাপ দেয়া হতো যেন ওকে এ থেকে জেড পর্যন্ত লেখা শেখাই। একটু খেলার জন্য স্কুল ছুটির পর কয়েক মিনিট যেন দেরি করি, তার জন্য কতো আকুতি মিনতির কথা ভুলি কিভাবে?
গতকাল যখন দেখলাম, দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাচ্চার স্কুলব্যাগের ওজন তার ওজনের যেন ১০ শতাংশের বেশি না হয় এরকম রায় দিয়েছে, তখন আমার কেবলই মনে হয়েছে হায়রে দেশ আমাদের! হায়রে আমাদের শিক্ষা, যা মাথায় ঢোকার আগেই তার ওজন বইতে হয় পিঠে। শিক্ষা যে জাতির মেরুদণ্ড তা গড়ার আগেই যেন ভাঙতে বসেছে। বইয়ের ভারে যেন আমাদের শিশুরা ঠিকমতো মেরুদণ্ড সোজা করে না দাঁড়াতে পারে, তার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করছি আমরা জেনেশুনেই।
এই ছোট্ট বিষয়টুকু, যারা শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত তারা বোঝেননি বলেই হাইকোর্টের তাতে মাথা ঘামাতে হয়েছে। এদেশে শিক্ষকরা একটি কথা সবসময় বলেন, “প্রতিটি বাচ্চা স্পেশাল”। তাই শিক্ষাব্যবস্থা যারা গড়ছেন, ভাঙছেন, এক্সপেরিমেন্ট করছেন তারা যদি একবারের জন্যও বাচ্চাদের এই স্পেশালিটিটা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতেন আমি জানি তারাও একই কথা বলতেন।
তাই একটা বাচ্চার মা হিসেবে এটুকু অনুরোধ তো আমি করতেই পারি তাদের কাছে, “ব্যাগের ওজন নয় বরং দেখুন পড়ার ওজন কতখানি চাপাচ্ছেন একটি বাচ্চার উপর। অন্তত বাইরের দেশ থেকে একটু শিক্ষা নিন”। বাঁচান আমাদের বাচ্চাদের, নিশ্চিন্ত হতে দিন অভিভাবকদের। আর আনন্দ নিয়ে যেন স্কুলে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে ওরা এই নিশ্চয়তাটুকু আমাদের দিন।