লামিয়া আহমেদ: শিরোনাম দেখে অনেকে নাক কুঁচকে এড়িয়ে যাবেন। বিরক্ত হয়ে হয়ত বিড়বিড় করবেন, এই তো আর একজন স্বামী তাড়ানো, রান্না না জানা, মা হতে না চাওয়া, পুরুষদের ঘৃণা করা নারীর ভ্যানভ্যানানি। আপনাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, উপরের কোনটিই আমি নই বা হতেও চাই না, তবুও আমি দিব্যি আগাগোড়া একজন ফেমিনিস্ট।
কারণটা খুব সহজ, অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুসারে, ফেমিনিজমের সংজ্ঞা হলো, The advocacy of women’s rights on the ground of the equality of the sexes. খুবই সহজ-সরল-যৌক্তিক এক লাইনের কথা,তবু কেন জানি এ বিষয়ে আমাদের অনেকেরই ভয়াবহ লেভেলের এলার্জি আছে।

অনেকে এ নিয়ে সস্তা কৌতুকও করেন। যেমনটা দেখেছিলাম এক হিন্দি সিনেমায় যেখানে নায়িকা বলছে, “ছেলেরা যা পারে, মেয়েরাও তা পারে”। নায়কের দুষ্টু উত্তর, “তাই যদি হয়, তবে এই আমি আমার শার্ট খুলে ফেললাম, তুমি খোল দেখি?” পেছনে নায়কের বন্ধুদের হো হো বিজয়ের হাসি, আর নায়িকার সলজ্জ পলায়ন। খুবই বিরক্তিকর থার্ড গ্রেডেড কৌতুক। জেন্ডার ‘ভিন্নতার কারণে নারী ও পুরুষের পোষাক ভিন্ন হতেই পারে, এর সাথে সমঅধিকারের সম্পর্ক কী, তা আমার জানা নাই। কারো জানা থাকলে আমাকে বিস্তারিত বলবেন।
অসৎ উপায়ে হওয়া বড়লোকের এলার্জি হলো গরিবের হকের উপর, ফেমিনিজমের উপর মানুষের এলার্জিটা অনেকটা সেইরকম। নারীবাদ পুরুষের পছন্দের বিষয় নয়, কারণ পুরুষতন্ত্র তাদের বসিয়েছে নারীর চেয়ে উচ্চতর আসনে। কিন্তু অনেক নারীকে দেখি, নারীবাদের কথা শুনলে রীতিমতো আঁতকে ওঠেন। কারণ বুঝি, পুরুষতন্ত্র তাকে পই পই করে শিখিয়ে দিয়েছে, দেখ মেয়ে, তুমি দুর্বল, তোমার শক্তিও কম, বুদ্ধিও কম। বাইরে শক্তিমান পুরুষেরা রাজকার্য করছে, তুমি বাইরে গেলেই ছিঁড়ে খেয়ে নেবে। তাই তোমার নিরাপত্তায় লাগবে আরো একজন পুরুষ, সে হতে পারে তোমার বাবা, ভাই, স্বামী কিংবা ছেলে। এই পুরুষেরা ভালো পুরুষ, তারা বাইরের খারাপ পুরুষের হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করবে।
তা বাইরের এই খারাপ পুরুষেরা কারা? তারা অন্য এক ঘরের “ভালো পুরুষ”। অনেকটা “সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝারো” টাইপ ব্যাপার। এখন, জীবনে একটা ভালো পুরুষ বাগাতে হলে, মেয়ে তুমি “করে নাকো ফোঁস ফাঁস, মারে নাকো ঢুশঢাশ” টাইপ হয়ে যাও, কোন একদিন এক স্বপ্নের রাজপুত্র ঘোড়া ছুটিয়ে তোমায় নিয়ে যাবে, বাকি জীবন তাকে খুশি রাখতে পারলেই খাওয়া-পরা ফ্রি।
তা এই থিওরি অনেক নারী বেশ পছন্দ করেন। এমন ফেইরি টেইল মার্কা নিশ্চিন্ত জীবন থাকতে কে যায় নারীবাদ ঠেঙ্গাতে? কিন্তু এমন জীবন সবসময়, সবার নাও থাকতে পারে, কিংবা মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়ায় সংসারের চিরচেনা রূপটা ভেঙ্গেও তো পড়তে পারে, তখন মেয়ে তুমি অবাক হয়ে দেখতে পাবে, তোমার আসলে কিছুই নেই, কোথাও যাবার জায়গা নেই, কোথাও পালাবার পথ নেই। জীবন মানে যদি যুদ্ধ হয়, তবে মেয়ে তুমি যুদ্ধে নেমেছ, ঢাল তলোয়ার ছাড়া।
সাধারণত, নারীকেই পুরুষতন্ত্রের ভিক্টিম হিসেবে দেখা হয় বা দেখানো হয়, অথচ অসচেতনভাবে পুরুষও এই সিস্টেমের শিকার হতে পারে, তা এ সমাজে কেউ ভাবতে চায় না। মেয়েকে বিয়ে দিতে না পেরে দড়িতে ঝুলে পরা বাবাটি এই পুরুষতন্ত্রের ভিক্টিম, বোনকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারানো ভাইটি এই পুরুষতন্ত্রেরই ভিক্টিম। সম্প্রতি মেয়েকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দু’পা হারানো বাবাও এই পুরুষতন্ত্রের জ্বলজ্বলে ভিকটিম।
শুধু পুরুষ হবার কারণে চিৎকার করে কাঁদতে না পারা ছেলেটি, কিংবা যে যুবক ভালো চাকরি পায়নি বলে বড়লোক প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারেনি, সেও এই পুরুষতন্ত্রের ভিক্টিম। অথচ কী আশ্চর্য, আমরা যখন এমন একটা সমাজের কথা বলি, যেখানে মেয়েরা সবক্ষেত্রে ছেলেদের সমান সুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠবে, নিজ যোগ্যতায় নিজের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে, ঘরে বাইরে যৌন নির্যাতনের ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে না, থাকতে হবে না, তখন লুঙ্গি পরা রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে প্যান্ট পরা ভদ্রলোক পর্যন্ত যেন চমকে ওঠেন। যেন তাদের বহুদিনের রাজমুকুট ধরে কেউ টানাটানি শুরু করেছে। নারীবাদ তাদের কাছে, নারীদের উলঙ্গ হবার পাঁয়তারা, সংসার না করার ফন্দি।
অথচ আপনি মনে প্রাণে কামনা করেন আপনার কন্যা যেন পরীক্ষা দিতে যাবার পথে প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক দ্বারা কোপ না খায়! আপনি নারীবাদকে মনে প্রাণে ঘৃণা করেন, কিন্তু আশা করেন, আপনার শিশু কন্যা ঘরে কিংবা বাইরে নিরাপদ থাকবে! আবার আপনিই কিনা বিশ্বাস করেন, পুরুষ নারীর চেয়েও উন্নত। এতোই উন্নত যে আপনি এই উন্নত প্রাণীটির কাছে নিজ কন্যার নিরাপত্তা নিয়ে সদা চিন্তিত। কেমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গেল না?
এমন হাজারো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আমাদের সমাজ। এর সমাধান কোথায়? কী করলে নারী তার প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাবে? ইতিহাস বলে, অধিকার কেউ কাউকে হাতে তুলে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়, নিজেকে তার যোগ্য করে তুলতে হয়। এ সমাজের প্রতিটা মেয়ে যেদিন ঘোড়া ছুটিয়ে আসা রাজপুত্রের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই একটা ঘোড়া কিনে ফেলার স্বপ্ন দেখবে, সেদিন থেকেই শুরু হবে নতুন পৃথিবী। নিজের একটা ঘোড়া না হয় কেনা থাকলো, সাথে রাজপুত্র জুটলে ভালো, না জুটলে ক্ষতি নেই।
আপনার কন্যাকে এমন স্বপ্ন দেখতে দিন, আপনার পুত্রকে শুধু লিঙ্গ সর্বস্ব পুরুষ না বানিয়ে মানুষ হবার শিক্ষা দিন। একাজ আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না, কারণ এ পৃথিবীর সবকটা মানুষ একজন নারীর জঠরে বেড়ে ওঠা, তারপর শরীর ভেঙ্গেচুরে বেরিয়ে আসা। আদরের শিশুটিকে নতুন পৃথিবীর পাঠ আপনিই তো দিতে পারবেন। আদিতে আপনিই ছিলেন জন্মদাত্রী, আবার আপনিই ছিলেন দুর্দান্ত শিকারি। একদিন আবার আপনার হাত ধরেই পুরুষ তার কল্পিত সিংহাসন ছেড়ে নেমে আসবে, এমন প্রেমময় সময়ের প্রতীক্ষায় রইলাম।