মোহছেনা ঝর্ণা: মানুষটা যখন আসে তার সাথে ভেসে আসে পরিশ্রমী ঘামের গন্ধ! সঙ্গ আরো থাকে মাছের আঁশটে গন্ধ! আশ্চর্য সেই গন্ধ কিন্তু একটুও দুর্গন্ধের মতো লাগেনা আমার। নাক, মুখও কুঁচকায় না। বরং বেশ আপন আপন লাগে।
কাজীর দেউড়ি মাছ বাজারে মাছ বিক্রি করে লোকটা। পোষাকের মলিনতা, চেহারার মলিনতা সব ছাপিয়ে যায় ঘোলা চোখের মায়ায়।
ভোটার আইডিতে জন্ম তারিখ দেখে বুঝেছি বয়স চল্লিশোর্ধ। কিন্তু পরিশ্রমী ক্লান্ত শরীরের মানুষটার মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, বয়স বুঝি ষাটোর্ধ্ব।
কথা বলার সময় জড়িয়ে যায়।একই কথা দু‘বার করে বলেন।
আপা টাকাটা কি আইছে? টাকাটা কি আইছে?
মানুষটার বউ থাকে ওমান। ওমানে এক বাসায় গৃহকর্মির কাজ করে। বাসার মালিকের বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। মালিক আছে, খারাপ না। প্রতিমাসে বেতন পেলেই মালিককে বলে টাকাটা দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে স্বামী ছাড়াও আপন বলতে আছে নিজের চারটি ছেলেমেয়ে। ছোট একটা ছেলে একদিন লোকটার সাথে এসেছে। বয়স পাঁচের বেশি হবে না। এই বাচ্চাটা প্রায় সময় মায়ের জন্য কাঁদে। আর তাই মানুষটার বউ মাঝে মাঝে বলে দেশে চলে আসবে। কিন্তু দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে যে দানবীয় ক্ষুধা সব মায়া, ভালোবাসা কেড়ে নিবে সেজন্যই আসা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ঋণের বোঝা তো আছেই।
বাচ্চাটার দিকে গভীর মায়া নিয়ে তাকাই আমি।
এই এক যন্ত্রণা হয়েছে আমার মেয়েটার জন্মের পর থেকে। আগেও আমি বাচ্চা দেখলে আদর করতাম, কোলে নিতাম। কিন্তু মেয়ের জন্মের পর প্রতিটা ছোট বাচ্চার মুখে আমি আমার মেয়ের মুখ দেখি। সে মুখের সামান্য মলিনতাও আমাকে খুব অসহায় করে তোলে। এই বাচ্চাটার জন্যও তেমনই এক মায়া অনুভব করলাম।
ছোট্ট একটা মানুষ। ছোট্ট একটা প্রাণ। যে প্রাণটা সারাক্ষণই চায় মায়ের বুকের ওম, অথচ মা তার সেই কোন মরুভূমির দেশে কেঁদে মরে, ছোট্ট অবুঝ বাচ্চাটা তা কি বুঝতে পারে!
পরপর কয়েকবার আসার কারণে এখন মানুষটার জড়সড় ভাবটা অনেকখানি কেটে গেছে। তাই তার রেমিট্যান্স প্রসেস করতে করতে টুকটাক কথা হয়। কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে অতি উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিতে গিয়ে কথা জড়িয়ে ফেলেন। দেখে মায়াই লাগে।
খুব কষ্ট করে ওমান গেছে মানুষটার বউ। চারটা বাচ্চার খাবার যোগাড় করা, শহরে বাসা ভাড়া করে থাকা (নদীর ভাঙ্গনে বসত বাড়িটা হারানোর পর থেকে শহরের বস্তিই ঠিকানা), প্রতিদিনকার খরচ, এগুলো মানুষটার একার আয়ে পোষাতে পারছিল না কিছুতেই। তাই অনেকটা নিরুপায় হয়েই এই বিদেশ যাত্রা। কিন্তু মনটা সবসময় এই দেশেই পড়ে থাকে, বাচ্চাদের কাছে।
ছোট ছেলেটার সঙ্গে যখন কথা ফোনে তার মায়ের কথা হয়, ও যখন বলে ‘আম্মা তুমি চইলা আসো, আমার কষ্ট হয়, তোমার লাইগা পেট পুড়ে’, তখনই নাকি কেঁদে বুক ভাসায় তার মা। ছেলেকে সান্ত্বনা দেয়, আর কয়টা দিন, বাপ, আর কয়টা দিন…।
সব জায়গায় আবেগ দেখানোর সুযোগ নেই। কিন্তু মন তো আর বেগ–আবেগ বোঝে না। তাই মানুষটার মিশ্র উচ্চারণে বারবার জড়িয়ে ফেলা কথাগুলো শুনতে শুনতে আর্দ্র হয়ে উঠি আমি।
চোখ ছলছল, ঝাপসা ভাব লুকিয়ে আমি যখন সবকিছু ঠিকঠাক করে ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকাটা নিয়ে যেতে বলি, তখন সারা মুখ ছড়িয়ে একটা হাসি দিয়ে এমনভাবে কৃতজ্ঞচিত্তে আমার দিকে তাকায়, মনে হয় আমার টাকাই বুঝি দিলাম।
আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি সেখানে রেমিট্যান্সের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। আমাদেরকে ট্রেনিং এ বারবার বলা হয় আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে যে দুটি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রবাসী ভাই–বোনদের গায়ের ঘামের গন্ধ লেগে থাকা এক একটা দিরহাম, এক একটা দিনার, রিয়েল, ডলার, পাউন্ড এগুলো শুধু কাগজের মুদ্রা নয়, এগুলো তাদের শরীরের রক্তকনা, এগুলো তাদের আবেগ মিশ্রিত দুঃখ ভালোবাসা, এগুলো এই দেশটাকে চালিয়ে নেয়ার ডিজেল, ফুয়েল। তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার কারণে আমাদের রিজার্ভ ফান্ড শক্ত হয়। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়।
আর এই ভিত্তি মজবুত করার জন্য কী অমানবিক পরিশ্রম যে তাদের করতে হয়, আপনজনদের সান্নিধ্য থেকে কী নির্মমভাবে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে হয়, নিজের দেশ, নিজের ঠিকানা ছেড়ে পরভূমে পড়ে থাকার যে কী যাতনা এটা শুধু তারাই জানে। আমরা যেন রেমিট্যান্স গ্রাহকদেরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সেবাটা দেই সে ব্যাপারে বারবার আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়, সতর্ক করা হয়, সচেতন করা হয়।

আমার নিজের আত্মীয় স্বজনদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রেমিট্যান্স পাঠায় দেশে। সেই রেমিট্যান্সের টাকায় বাচ্চাদের নতুন জামা কেনা হয়, ঘরে ভালো–মন্দ রান্না হয়, টিনের বেড়ায় রঙ লাগে। আর সব আনন্দের মাঝে দূর দেশে থাকা মানুষটার কথা কিছু সময় বেদনা ভরা নয়নে স্মরণ করা হয়।
এখন অবশ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে দূরে থাকা মানুষটাকে চোখে দেখা যায়। খুব কাছ থেকে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর প্রবাস জীবনের কষ্টের কথা শুনেছি বলেই কিনা এই মানুষগুলোকে আমার খুব আপন মনে হয়। খুব কাছের মনে হয়।
এবার এসে বললেন, আপা, আর কয়টা মাস কষ্ট কইরা শুধু ঋণের টাকাটা শোধ করতে পারলে ওরে চইলা আসতে কমু। পোলাপানগুলা মায়ের জন্য কাঁদে। কষ্ট লাগে। বাচ্চা মানুষ, মারে ছাইড়া থাকতে পারে কন! হেরও ভালো লাগে না, ওগো ভাষা বুঝে না, কথা কওনের মানুষ নাই, কেমন থাকে কন! কইছি ঋণটা শোধ হইলে আইয়া পড়তে।
আহা! কী অনুভব!
মানুষটা ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবারই এসে আমাকে বলে যাবে আপা যাই, সামনের মাসে আবার টাকা পাঠাইলে আসমু। কথা বলার সময় যে কৃতজ্ঞতায় তিনি নুয়ে থাকেন তাতে আমি লজ্জিত হয়ে যাই অধিক প্রাপ্তিতে।
তখন আমার মনের মাঝে গুনগুন করে বেজে ওঠে অতুল প্রসাদের গান,” আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি, যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি।