মিজানুর রহমান (উইমেন চ্যাপ্টার): টানা পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন, দেশের বিভিন্ন পৌরসভা নির্বাচন, কয়েকটি উপ-নির্বাচন, এর আগে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন, কোনটির ফলাফলই আওয়ামী লীগের অনুকূলে ছিল না। একের পর এক হার দলটিকে কিছুটা হলেও মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন ঠিক ছিল কিনা। রহস্যের জাল ছড়াচ্ছে কেনই বা ৪০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ৪০ শতাংশ না বলে ৪ লাখ ভোটার বলাই শ্রেয়।
সিটি নির্বাচনে গাজীপুরের স্থানীয় ভোটার মাত্র ৩৮ শতাংশ। আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দুর্গ নামে খ্যাত এই গাজীপুরে কতজন স্থানীয় ভোটার ভোটকেন্দ্রে গেছেন সেটিও একটি প্রশ্ন। যদি না গিয়ে থাকেন, তাহলে কেন যাননি? এমন প্রশ্নের উত্তরে চলে আসে জাহাঙ্গীরের প্রসঙ্গ। অনেক সংবাদ মাধ্যমের দাবি, মোট ভোটারের প্রায় ৩০ শতাংশ জাহাঙ্গীরের সমর্থক ও আওয়ামী লীগ কর্মী। তাহলে কেন জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন না দিয়ে আজমত উল্লাহকে মনোনয়ন দেয়া হলো সেটিও বহুল আলোচিত ইস্যু। তবে আজমত উল্লাহর প্রাপ্ত ভোটের চাইতে যে আওয়ামী লীগের সমর্থন গাজীপুরে ঢের বেশি সেটা বুঝতে কারো বাকী নেই।
ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে আপাতত সবচাইতে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা হচ্ছে নেগেটিভ প্রচারণা ও ধর্মের ব্যবহারকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, নেতিবাচক প্রচার আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। তাঁর মতে, গাজীপুরের নির্বাচনে প্রার্থী বা এলাকার উন্নয়ন নিয়ে মাথা ঘামাননি ভোটাররা।
তিনি আরো বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নেতিবাচক দিকগুলোকে নিয়ে প্রচারণা মূলত বিরোধী দলীয় প্রার্থী জনপ্রিয়তা পান।’
এদিকে হেফাজতের প্রচারণা একটা বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে মান্নানের বিশাল জয়ের জন্য। অনেকেই মনে করছেন, নির্বাচনী প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার রোধে কঠোর আইন করার সময় চলে এসেছে।
পরাজয়ের কারণ যাই হোক না কেন ফলাফলের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে ব্যস্ত বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে ভোটের দিন সারাদিন নানান ধরনের কারচুপি ও সমস্যার কথা বলে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করলেও দিনশেষে ফলাফল প্রকাশের পর জনতার রায় বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়।
সাধারণ সমাজে অনেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সততার জন্য বাহবা দিলেও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এমন কোন কথাই বলা হয়নি এখনো। বরং তাদের বলতে শোনা গেছে, ফল পরিবর্তনের চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে গণরায় জয়ী হয়েছে।
দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ প্রমাণ করে দিয়েছে তারা আর এই সরকারকে চায় না। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখনো সময় আছে, সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার পুনর্বহাল করে জাতীয় নির্বাচন দিন। অবিলম্বে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল না করলে জনগণই তা আদায় করে নেবে।
বিএনপির নেতাদের কার্যক্রম দেখে বোঝা যাচ্ছে, যতই সুষ্ঠু নির্বাচন হোক না কেন, তাদের কথা দুই জায়গায়ই আটকে থাকবে। হারলে নির্বাচনে কারচুপি এবং জিতলে জনগণ তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে রায় দিয়েছে।
এদিকে ফলাফলের বাস্তবতা মেনে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মনোনীত প্রার্থীর হারে তারা মুষড়ে পড়লেও নির্বাচনকে মেনে নিয়েছেন তারা। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লাহ নির্বাচনের সময় থেকেই বলে যাচ্ছিলেন, ফলাফল যা’ই হোক না কেন মেনে নিবেন তিনি।
আওয়ামী লীগ আপাতত নিজেদের ভুল সংশোধনে ব্যস্ত। বর্তমান সময়ের সবচাইতে সফল মন্ত্রীদের একজন যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মনে করেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার দলীয় মেয়র প্রার্থীর পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুল সংশোধনের কাজে লাগাতে হবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, জনগণ কি কারণে ভোট দেয়নি তা অনুসন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করে আগামী সময়ে তার সংশোধন করা হবে।
কারণ, ফলাফল, প্রতিক্রিয়া যা’ই হোক না কেন নির্বাচন কমিশনকে এতটা স্বাধীন অন্য কখনো দেখা যায়নি। প্রতিটি নির্বাচনেই সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন হয়েছে। আশা করি সকল রাজনৈতিক দল ভালোকে ভালো ও খারাপকে খারাপ বলতে শিখবেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও এর ফলাফল থেকে পরাজিত দল শিক্ষা নিবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য আপাতত এই কামনাই রইলো। পরিশেষে বলাই যায়, জনগণের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতির দিকে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। এই যাত্রাকে স্বাগত জানাতে হবে সবাইকে। ক্ষমতার দাপটের রাজনীতির ইতি হোক এখানেই।