লুকানো ডায়েরি থেকে-৩

চেনা অপরিচিতা: ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় আমার জন্য হুজুর রাখা হয়। তিনি স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মূলত নামাজ, কোরান শরীফ আর স্কুলের ধর্ম শিক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়ার জন্য আম্মা তাকে পড়াতে ডাকেন। হুজুর খুব হাসিখুশি, কিন্তু কেন যেন সব সময় ছুঁতে চাইতেন। হাত তো ধরবেনই, সুযোগ পেলে অন্য কোথাও তার স্পর্শ আমাকে ভাল অনুভুতি দিত না। ক্লাস সিক্সে এসেই যে তিনি এমন করেছেন তা নয়। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার স্পর্শ গুলো স্নেহশীল ব্যবহারের সাথেই হোক, তা আমার নারীত্বে প্রশ্ন জাগাতো। ক্লাস সেভেনে আমার বাসায় আমার বন্ধুরা এসেছে। তাদের নিয়ে রীতিমত বাবা মা কিভাবে সন্তান উৎপাদন করেন তার ক্লাশ নিলেন উনি।

stop-2আমি আগেই বলেছি, আমার দৈহিক গড়ন আর মানসিকতা বিপরীতমুখি ছিল। হয়তো ক্লাস নাইনে পড়ি। ভাইয়ার একটা গেঞ্জি খুব ভাল লেগেছে। ঢোলা আর প্রিন্টটা অন্যরকম। সেটা পরে ওড়না মাথায় দিয়ে হুজুরের সামনে গেলাম। হুজুর গেঞ্জির ডিজাইনটা দেখতে চাইলেন। আমি ওড়না সরিয়ে দেখালাম। হুজুর আমার বুকের ওপরের ডিজাইনটা হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন।

পাশে বসলে পিঠে হাত বোলানো খুব কমন ছিল। মনে হতো কোথায় ব্রা রয়েছে তার অবস্থান পরীক্ষা করছেন।

একটা সময় উনার হাত ধরা অসহ্য হয়ে গেল। সাবধান করলাম, হাত যাতে আর না ধরে। কিন্তু,আমার কথার গুরুত্ব হয়তো তিনি অনুধাবন করেননি। কিন্তু আমি মরিয়া ছিলাম। তাই একদিন জ্যামিতি বক্সের কম্পাস সজোরে গেঁথে দিলাম তার হাতে। অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু এতে কাজ হয়েছিল।

ওনার এই সব কর্মকাণ্ড উনি অন্যদের সাথেও করতেন। এক মেয়ের বাবা তা আবিষ্কার করে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আমিও বলেছিলাম উনার ব্যাপারে আমার মাকে। আমার মা সহানুভূতি দেখালেন ঠিকই, কিন্তু বললেন, এসএসসি পর্যন্ত কায়দা করে চলতে। আমি কায়দা করেই চলতাম।

ছোট থেকেই দেখেছি, ধর্ম নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে তাদের মধ্যেই চরম গলদ। আমাদের বাসায় একটা লোক আসতো। কোরানে হাফেজ। মুরগী বেচতো। সে এসে একদিন আমাদের বাসার গৃহকর্মী ১১/১২ বছরের মেয়েটিকে আড়ালে নিয়ে তার বুক কচলে হাতে ১০টাকা দিয়ে চলে যায়। হুজুরদের ওয়াজে মেয়েদের অশ্লীল বর্ণনা না দিলে ওয়াজ জমে না। আগত মুসুল্লিদের দাড়ির ফাকে একটু যদি লোল টানার সুযোগই না আসল তাহলে আর বোরিং ওয়াজ মানুষ শুনবে কেন?

আমাদের বাসায় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী এক মহিলা ছিলেন। উনি একদিন কাঁচা বাজারে গেলেন আর সেখান থেকে ফিরে মহা উত্তেজিত হয়ে আমার মাকে টানতে টানতে জুতো পরিয়ে শাড়ী পরিয়ে বাজারে টেনে নিয়ে গেলেন। যা বোঝা গেল আসার পর, তা হলো, ধর্মের লেবাসধারী এক সবজি বিক্রেতা তাকে কোন বাজে অঙ্গভঙ্গি করেছে, বা কটূক্তি করেছে। সে তার বিচার চায়। আমার মা সেখানে গিয়ে বেশ হৈ চৈ করেছিলেন, আর ঐ মহিলা ঐ লোকের সামনে রাখা লাউগুলো বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া শাবল দিয়ে লন্ডভণ্ড করে এসেছিল।

এসএসসি পরীক্ষার পর খুব শখ হলো একটা মডেল পোর্টফলিও করার। আমার বন্ধু করেছিল। খুব সুন্দর এসেছিল ছবিগুলো। গেলাম খুব বিখ্যাত একজন ফটোগ্রাফারের কাছে। উনি ছবি তুললেন। কিন্তু এক ফাঁকে আমার মা আর বন্ধুরা যখন পাশের ঘরে কিছু আনতে গেল, তখন উনি আমার পোশাক টাইট করার উছিলায় আমার বুক ও অ্যাডজাস্ট করে দিতে লাগলেন। লজ্জায়, ঘটনার আকস্মিকতায় লাল হয়ে গেলাম। বাসায় এসে মাকে বলতে পারিনি। দোষটা আমার ঘাড়েই পরবে। ছবি তলার জেদ আমিই করেছি। শুধু প্রিয় বন্ধুটিকে বলেছিলাম।

সেই ফটোগ্রাফার বিখ্যাত কারো সাথে এমন করার সাহস নিশ্চয়ই পান না। আমার মত ভিরু কিশোরীকে যদি আড়ালে একটু হাতানো যায় তাহলে ওনার পুরুষাঙ্গে একটু রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, সেটার আনন্দ হয়তো অপরিসীম। সেটা আমরা বুঝব কেন!  

যাই হোক, আমার ওভারির অসুখ বারডেমের হরমোনের ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আস্তে আস্তে ভাল হয়ে গিয়েছিল। আমরা মা-মেয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। তখন আজ বাদে কাল ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। অনেক পড়া। বেতারে একটু-আধটু গান গাওয়ার শুরু। কিন্তু বেতারে ওদের তালিকাভুক্ত গীতিকার ছাড়া গান গাইতে দেয় না। বেশী বিখ্যাত বা সিনেমার গানও গাওয়া যাবে না। বড় মুশকিল! তালিকাভুক্ত গীতিকার কোথায় পাই? আম্মার গাওয়া গানগুলো রিপিট করে গাই।

এরকম সময় রেডিও অফিসে এক ভদ্রলোকের সাথে আম্মার কথা হয়। ৩৫ থেকে ৪০ এর কোঠায় হবে বয়স।  বিবাহিত। উনি শিল্পী ও গীতিকার। উনাকে আম্মা বাসায় ডাকেন আমাকে কিছু গান তুলে দিতে। তিনি রাজী হন। এক সন্ধ্যায় গান তুলে দেবার পর উনি চলে যাবেন। আম্মা বাইরে। সামনে টানা বারান্দা পেরিয়ে অন্ধকার করিডর। উনি হঠাৎ সেই অন্ধকারে থমকে দাঁড়ালেন।

আমি কেন যেন সেই অন্ধকারে যাইনি। কাঁপা কাঁপা গলায় আমাকে পছন্দ করেন এ জাতীয় কিছু বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ড শেকের মতো। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার হাত বাড়ানো উচিৎ হবে কিনা। আমি হাত না বাড়ালে উনি ভাববেন আমি বাজে কিছু ভাবছি। আমি হ্যান্ডশেক করলাম। করেই বুঝলাম, উচিৎ হয়নি। ওনার হাত গরম আর কাঁপছে। দুই হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন। স্পর্শ অনেক কিছু বলে। বন্ধুতা, প্রেম। তবে, এই স্পর্শ নিখাদ কামনার।

লোকটিকে কোনমতে বিদায় দিয়ে একরাশ ক্লেদ মনে জমিয়ে পড়তে থাকলাম। মাকে আসার পর সব বললাম। মাও কথা শোনালো, যে উচিৎ হয়নি। তবে নিয়ন্ত্রিত ভাবে, কারণ কাল পরীক্ষা।  এই অনাকাঙ্ক্ষিত কলুষতা সব মেয়েই হয়তো দিনের পর দিন পলিমাটির মত জমিয়ে বুকে চর ফেলে দেয়। কেউ তার খবর রাখে না। মজার ব্যাপার হলো, এ জাতীয় লোক অন্যায় আচরণ করার পরও কনফিডেন্স হারায় না। এদের ভদ্রলোকেরা সরাসরি বলে না। এড়িয়ে যায়। কিন্তু এই এড়ানো টা এরা নিতে পারে না। বিচার চাই বিচার চাই –এর মত আস্ফালন করতে থাকে।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর একদিন শুনি আম্মা যেন কার সাথে কথা বলছে। শুনে বুঝলাম, সেই পেডোফাইল। কথা শেষে আমার আচরণ আর কথায় আর বাকীটা আম্মার প্রশ্নে আম্মা জেনে যায় কী ঘটেছিল অনেক বছর আগে। আম্মা থম মেরে যায়। কিছু প্রশ্ন ব্যবচ্ছেদ করে আমার সত্ত্বা।  আমি চুরমার হই। আর আমার মা চুপ থাকে দুটো দিন।

একা একা হয়তো অনেক হিসাব মেলাতে চান যেগুলো বড্ড জটিল উত্তর আনে। নিজেকে খুব ঘেন্না লাগছিল আমার। আমি আম্মাকে একসময় জিজ্ঞাসা করলাম, “আম্মা, তুমি কি আমাকে ঘিন্না কর?” আম্মা করুণ চোখে তাকিয়ে বললেন, “না, তুমি তো ছোট ছিলা, তোমার কী দোষ?” তাও আমি মনমরা থাকি। আমার মা তখন আমাকে আমার বন্ধুদের বাড়িতে নিয়ে যান। এই একটা কাজের জন্য আমি তার সব অন্যায়-আচরণ ক্ষমা করে দেই। আমার বন্ধুদের সাহচর্য বড় প্রয়োজন ছিল সে সময়। তখন জানার কথা ছিল না, জীবনের চরম যন্ত্রণার দিনে সেই নরকের কীটের গলাবাজি আমাকে সহ্য করতে হবে।

(চলবে…)  

শেয়ার করুন: