পুরুষ, তোমার ভারি রাগ, তাই না?

সালমা লুনা: বদটা গণপিটুনি খেয়ে পুলিশ কর্তৃক ধৃত হয়ে শ্রীঘরে। পুলিশের কাছে জবানবন্দী দিয়েছে সে সব স্বীকার করে। আদালতে অবশ্য এখনো দেয়নি। ধারণা করি আদালতে উল্টে যাবে গণেশ। কারণ সামনে চলে এসেছে তার পেছনের কৃতকর্ম, তাছাড়া মাথা ঠাণ্ডা হলে অথবা তার উকিল বা স্বজনরা যেভাবে তাকে বাঁচাতে চাইবে সেরকম জবানবন্দীই সে নিশ্চয়ই দেবে।

বদ যাকে কুপিয়ে মৃতপ্রায় করেছে সেই খাদিজা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

Salma Luna
সালমা লুনা

এসব সবাই জানে। এও জানে বদ কেন কুপিয়েছে খাদিজাকে। তাছাড়া পুলিশের কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছে বদ তাতেও সে বলেছে কেন একাজ করেছে সে। আমরাও সকলে জেনেছি, সে বয়ান দিয়েছে খাদিজার সাথে তার মহব্বত ছিলো। খাদিজা কিছুদিন যাবত পরিবারের কথা বলে তাকে এড়িয়ে চলছে। সে এটা মেনে নিতে পারেনি। ঘটনার দিন খাদিজা তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করায় তার রাগ উঠে যায় এবং রাগের মাথায় সে খাদিজাকে কোপায়।

রাগের মাথায়ই সে চাপাতি কিনে এনে কোপানোর আয়োজন করে। তার অনেক রাগ!

সে খাদিজাকে ভালোবেসেছে(!!) সেই ২০১২ সাল থেকেই। এজন্য তখন সে নিগৃহীতও হয়েছে। ধারণা করি, তখন থেকেই তার রাগ বা জেদ – “যে মেয়ের জন্য এত হেনস্থা, তার সাথে প্রেম করেই ছাড়বো। সবাইকে দেখিয়ে দেবো।”

আকছার ঘটে এমনটা এদেশে। এমনকি আমাদের নাটক-সিনেমাগুলোও এই জিনিসটা খুব ভালো করে দেখিয়ে থাকে এবং আমরা বিনোদিত হই।

তো খাদিজা কী করেছে?

সেও ভালোবেসেছে অথবা বাসেনি।

ধরা যাক, খাদিজা একদা বদটাকে ভালোবেসেছিলো। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে, বদের কোন আচরণে বা নিছক ইচ্ছাই করছে না আর ভালোবাসতে তার ঐ বদকে … তাই সে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে।

কিন্তু বদ তো পুরুষ! সে কেন মানবে? এরকম করতে পারবে শুধু পুরুষ! একজন নারী একবার কোন পুরুষকে ভালোবাসলে তাকেই আমৃত্যু ভালোবাসতে হবে। তার সাথেই সারাজীবন কাটাতে হবে।

না হলে কী হবে?

পুরুষটি রেগে যাবে। রেগে গেলে কী হবে?

আর খাদিজা যদি সত্যিই ভালোবেসে না থাকে ঐ বদকে কখনোই! কোনদিনই !

তাহলেও তো মেয়ের কতো সাহস ! কেন ভালোবাসবে না? একটা ছেলে! একটা পুরুষ! .. সে মেধাবী , কালো কুচ্ছিত নয়, ব্যাকাতেঁড়া খোমা না, লুলা ল্যাংড়া না, দিব্যি দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে … বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে , নামকরা রাজনৈতিক দল করে, একটি হাইস্কুলের শিক্ষক …. সর্বোপরি একজন পুরুষকে কোনো নারী কেন না করবে? পুরুষের রাগ তো উঠবেই !

সে ভীষণ রেগে যাবে। রেগে গেলে কী হবে?

আমার নানী খুব স্পষ্ট করে নীচু গলায় বলতেন, ‘এত ত্যাজ দেহাছ কেরে? মেয়ে মাইনষের অত ত্যাজ ভালা না। জানছ না! মাইনষে কয় ৱ, বেইট্টানের ত্যাজে বেশ্শা আর ব্যাডাইনের ত্যাজে বাদশা’।

আমার নানীর সেই ‘মাইনষের’ কথা কখনোই ঠিক হতে দেখিনি এই জীবনে। বরং উল্টোটাই দেখেছি বরাবর।

পুরুষ রেগে গেলে ভয়ঙ্কর! এবং সেই ভয়ঙ্কর পুরুষ যা যা করতে পারে তা আমরা জানি। রেগে যাওয়া পুরুষের এমনিতেই প্রধান লক্ষ্য নারী। আর যদি নারীকে তার অপরাধী মনে হলো, তাহলে তো কথাই নেই!

গালি, কুৎসা রটনা, মারধর তো ডালভাত! আত্মীয় বা অনাত্মীয় যেকোন নারীর সাথেই এসব করা যায় অনায়াসে। এমনকী এসিড ছোঁড়া, ধর্ষণ করা, পুড়িয়ে কুপিয়ে মাটিতে পুঁতে যেকোন নৃশংসভাবে হত্যা করা পর্যন্ত, সব ….সবই করতে পারে রেগে যাওয়া পুরুষ।

রেগে যাওয়া পুরুষের কাছে তার স্বজাতিরও রক্ষা নাই।

ওখানেও অবশ্য নারীকে হাতিয়ার করা হয়। পুরুষটির উপর রেগে গেলে তার প্রিয় নারী আত্মীয়ার উপর রাগ ঢেলে বা কিছু না পারুক, খ ম এর বাচ্চা কিংবা বিশেষ যৌন কাজটি করার ইচ্ছা পোষণ করতে অনেক ‘শিক্ষিত’ কেও হরহামেশাই দেখা যায়।

এমনই যে পুরুষের রাগ সে বাদশা হবে কীভাবে?

অনেক পুরুষকে এমনকি নারীদেরও বলতে শুনেছি পুরুষ মানুষের একটু রাগ থাকেই ! পুরুষ মানুষ রাগ করলে তার সাথে রাগ করতে হয় না। কিংবা পুরুষটি নিজেই বলে, আমার রাগ তুলিও না! রেগে গেলে আমি ভয়ঙ্কর! আমার যখন রাগ উঠে সামনে আসবে না, তর্ক করবে না।

অনেক পুরুষই স্ত্রী-বোন-কন্যার গায়ে নির্দ্বিধায় হাত তুলে আবার স্বাভাবিক আচরণ করে এই বলে যে, রাগ উঠে গিয়েছিল। কেন যে আমার রাগ উঠাও!

অর্থাৎ রাগ উঠেছে, তাই দুঘা দিয়েছি। এবার রাগ পড়েছে, সব ঠিকঠাক। এটাই স্বাভাবিক ।

পুরুষ রেগে গেলে কী হয়?

সে হিংস্র হয়। সে গালি দেয়, মারমুখী হয়, আক্রমণ করে। সে ক্ষেত্রবিশেষে ভয়াবহ অপরাধী, ধর্ষক খুনী এসবই হয়, হতে পারে। হচ্ছেও।

পুরুষ নিজের এহেন রাগ নিয়ে গর্বিত। যে পুরুষ অন্য আরেকটি পুরুষের রাগ দেখে, বউ পেটানো দেখে ভদ্দরলোক সেজে ছিছিক্কার করে। সেও মজলিশে, আড্ডায় গল্পচ্ছলে বলে রাগ উঠলে কিন্তু আমি চাঁড়াল!

এমনই রাগ পুরুষের!

যে রাগ একবার উঠে গেলে রক্ষা নাই। যে রাগে প্রত্যাখাত হলে বাজারে গিয়ে পছন্দ করে চাপাতি কিনে এনে ঝপাঝপ মানুষ কোপ দেয়া যায়। চুলের মুঠি ধরে টেনে ঝোঁপে মানুষকে টেনে নিয়ে ফেলে শরীরটাকে খুবলানো যায়। যে রাগে তুই অমুক মায়ের সন্তান বলে উচ্চ শিক্ষিত মানুষটিও খিস্তি করে। যে রাগের প্রকাশ দেখে কে অশিক্ষিত দর্জি আর কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা শিক্ষক তার ভেদাভেদ ঘুচে যায়। যে রাগের জন্য না জানি কত পরিবারে প্রতিদিন একজন করে বদরুল জন্ম নিচ্ছে! নেশাগ্রস্ত বা একটা ধর্ষকের জন্ম হচ্ছে! যে রাগের শিকার হয়ে না জানি কত নারী প্রতিদিন আত্মহত্যা করে কিংবা ধুকে ধুকে বেঁচে থাকে। কত পরিবার নিঃশেষ হয়ে যায়!

এমনই তোমার রাগ পুরুষ!

এই রাগ নিয়ে তুমি বাদশা হবে?

এই রাগ নিয়েই তোমার বড়াই?

এই রাগ নিয়েই তুমি ভেতরে ভেতরে একটা জানোয়ার হয়ে ভদ্রতার মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াও সভ্য সমাজে !

তোমার ভারি রাগ! তাই না?

শেয়ার করুন: