মেয়েদেরকে ‘বেশ্যাকরণ’ প্রকল্প বন্ধ করেন

নাদিয়া ইসলাম: স্লাট-শেইমিং-এর ভালো বাংলা আমার জানা নাই। ‘স্লাট-শেইমিং’ অর্থ চরিত্র-হনন হইতে পারে, চরিত্রে কলংক-লেপন হইতে পারে, অপমানিত করা বা লজ্জা দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস হইতে পারে, কিন্তু উপমহাদেশে মেয়েদের উপর এর বহুল ব্যবহার থাকলেও সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে ‘এক-শব্দে’ এরে ব্যাখ্যা করা যায় এমন কোনো শব্দ এই অঞ্চলে আবিষ্কার হয় নাই। বা হইলেও তা আমার জানা নাই।

RAPআমার ভাষায় স্লাট শেইমিং হইলো মেয়েদের বেশ্যাকরণ প্রকল্প। অর্থাৎ যেই ‘শক্তিমান’ মেয়েরে অন্যান্যভাবে খাটো করা যাইতেছে না, তার চরিত্র নিয়া প্রশ্ন কইরা তারে মাটিতে শোয়াইয়া আক্ষরিক বা রূপক অর্থে ন্যাংটা কইরা আক্ষরিক বা রূপক অর্থে পিটানোর বা মাইরা ফেলানোর নাম ‘স্লাট-শেইমিং’।

রানী প্রথম এলিজাবেথের মা রানী এ্যান বো’এইন ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরির দ্বিতীয় স্ত্রী। এ্যান বিখ্যাত (বা বলা ভালো, কুখ্যাত) ছিলেন তার জেদী, উচ্চাকাংখী, অনমনীয়, অবাধ্য ও ঘাড়-ত্যাড়া চরিত্রের জন্য। একে তিনি জন্ম দিছেন কন্যা সন্তান, তার উপর ঘাড়-ত্যাড়া, এমন মেয়েরে মাইনা নিবেন, ১৫ শতকের পেট মোটা রাজার এত সহ্যশক্তি হয় নাই। সুতরাং, এ্যানের উপর ‘অপ্রমানিত’ ব্যাভিচারের ট্যাগ লাগাইয়া তারে জনসম্মখে জবাই করা হইলো। এ্যানের কন্যা রানী প্রথম এলিজাবেথ কোনোদিন বিয়া করেন নাই। তিনি আজীবন কুমারী ছিলেন।

ইংল্যান্ডের স্বর্ণযুগের একজন ক্যারিশম্যাটিক- বুদ্ধিমান- বিচক্ষণ- প্রজাবান্ধব শাসক, যিনি ক্রাউন, চার্চ এবং সংসদ, এই তিনরে একইভাবে সমান দক্ষতায় সামলাইতে পারতেছেন, এমন একজন ১৬ শতকের কমবয়স্ক মেয়েরে, তাও আবার অবিবাহিত, মাইনা নেওয়া সবার জন্য সহজ হিসাব ছিলো না। তার বিরুদ্ধে প্রচুর রসালো গল্প চালু ছিলো, তার মধ্যে একটা হইলো, তিনি নাকি আসলে মেয়েই ছিলেন না! ১৯১০ সালে লেখক ব্র্যাম স্টোকারের উপর ওহী নাযিল হইলে তার ‘ফেমাস ইমপস্টারস’ বইয়ে লেখেন- রানী এলিজাবেথের ছদ্মবেশে কোনো একজন পুরুষ নাকি ইংল্যান্ডরে বোকা বানাইয়া ৪৫ বছর ধইরা শাসন কইরা গেছেন! (কারণ, কোনো ‘একলা’ মেয়ের পক্ষে রাজ্য শাসন অসম্ভব কীনা, হাহা!)

মিশরের রানী ক্লিওপেট্রার ঘটনাও একইরকম। একজন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ‘ব্যক্তিস্বাধীন’ মেয়ের ‘এত’ ক্ষমতা হজম করতে না পাইরা পুরুষের স্বভাবজাত সেক্সুয়াল অস্বস্তি এবং নৈরাশ্য ও নারীবিদ্বেষ থিকা তারে স্লাট-শেইমিং কইরা ব্যাভিচারি বানানো হইছিলো একসময়।

স্লাট-শেইমিং কী কী কারণে হয়, তার প্রচুর পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা আছে। এইযুগের জন্য সবচাইতে হাস্যকর ব্যাখ্যা ‘বিবর্তনবাদ’ মারফত এক প্রকার সিউডো-বায়োলজিক্যাল ‘জেনেটিক্যালি হেরেডিটরি’ ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা বলেন, বিবর্তনবাদ মেয়েদের নিজের মানব-স্পিশিস টিকাইতে নিজের গোত্রের ভিতর ‘সবচাইতে’ ‘নিরোগ’, ‘সামাজিক-ভাবে উচ্চস্থানীয়’, ‘অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী’, ‘নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন’ ‘একজন’ ‘শক্তিশালী’ ‘সুদর্শন’ পুরুষের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বাচ্চা জন্ম দেওয়ারে উৎসাহিত করে। হ, ভালো কথা!

কিন্তু এই ব্যাখ্যা সঠিক হইতে পারে প্রি-হিস্টরিক থিকা সামন্তযুগীয় অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক মানুষের জন্য, যেইখানে মেয়েদের দাম তার ভ্যাজাইনার দাম দিয়া ঠিক করা হয়। হান্টার-গ্যাদারার সমাজে যেইখানে পুরুষের কাজ খাদ্য সংগ্রহ এবং মেয়েদের কাজ বাচ্চা উৎপাদন, সেইখানে একজন মেয়ে একাধিক পুরুষের সাথে শুইলে সেইটা সমাজের সামন্তপ্রভুদের সম্পত্তি রক্ষার লড়াইয়ে ক্যাটাস্ট্রফিক একটা ঝামেলা তৈরি করতে পারে, বা একজন মেয়ের একাধিক পুরুষ সঙ্গী থাকলে সবচাইতে ‘সঠিক’ ‘আলফা-মেল’ পুরুষ সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার ‘খারাপ’ বিচারবোধ মারফত তিনি নিজেরে এবং নিজের ভবিষ্যত সন্তানরে বায়োলজিক্যাল ঝামেলায় ফেইলা দিতে পারেন, তাই সেই সমাজে মেয়েদের বহুগামিতা ঠেকাইতে স্লাট-শেইমিং ‘হয়তো’ দরকারী বিষয় ছিলো।

Women beatingএকইভাবে ঐ সমাজে একজন পুরুষের একাধিক মেয়ের সাথে শোয়াও বিবর্তনবাদ (এবং ধর্ম) সমর্থন করে, কারণ, যত বেশি স্ত্রী, তত বেশি সন্তান এবং তত বেশি বায়োলজিক্যাল জিনের মারফত ‘নিরোগ’ উত্তরসূরী তৈরি ও সেই মারফত তত বেশি সম্পত্তি দখলের সম্ভাবনা থাকে। একজন বিড়াল একইসাথে পাঁচজন বাচ্চা যেই কারণে প্রডিউস করেন, একজন পুরুষও সেই একই কারণে বহুগামিতা প্র্যাকটিস করছেন ঐ সময়। মেয়েরা পাঁচজন বা পাঁচশ’জন বাচ্চা একসাথে জন্ম দিতে পারলে পুরুষের বহুগামিতা ঠেকানো যাইতো কীনা এইটা একটা গবেষণার বিষয় হইতে পারে, সিরিয়াসলি।

কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদি সমাজে যেইখানে মেয়েরা পুরুষের সমান উপার্জন কইরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন, সেই যুগে স্লাট-শেইমিং শুধুমাত্র একজন মেয়ে কয়জন পুরুষের সাথে শুইতেছেন, অর্থাৎ বহুগামিতা দিয়া নির্ধারিত হয় না। একজন মেয়ে, যিনি পুরুষ সিংহের ক্ষমতা অগ্রাহ্য কইরা নিজ গৌরবে ও মহিমায় বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ এবং সর্বোপরি হলিউডি হৃদয়-আর্দ্র করা ‘মেয়েদের একগামিতা’ এবং ‘পুরুষের বহুগামিতা’ প্রমোট করা ঢিস্টিং ঢিস্টিং প্রেমের সিনেমার বিরুদ্ধে খাড়াইয়া ডিভোর্স দিয়া বা না দিয়া, একাধিক পুরুষের সাথে শুইয়া বা না শুইয়া, বাচ্চা পয়দা কইরা বা না কইরা নিজের যুদ্ধ একলা চালায়ে যাইতেছেন, তারে পুরুষতান্ত্রিক- পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও ধর্মের বড়ই ভয়! আর এই ভয় থিকাই শুরু হয় স্লাট-শেইমিং।

এবং এই স্লাট-শেইমিং শুধু যে পুরুষ করেন, তা না, পুরুষতন্ত্রের নারী চাকরেরাও সেই কাজে সমান পারদর্শী। আমাদের মা খালারাই ডিভোর্সি একটা মেয়ের দিকে চোখ ব্যাঁকা কইরা তাকান, আমাদের মেয়ে বন্ধুরাই পেট বাইর কইরা শাড়ি পরা, ব্রার স্ট্র্যাপ বাইর হইয়া থাকা আমাদের বেশ্যা ডাকেন, আমাদের বড় বোনরাই আমাদের ছেলেবন্ধুদের সাথে ঘুইরা বেড়াইতে দেখলে আমাদের শরীর এবং নৈতিকতা নিয়া বড় বড় লেকচার দেন। তাতে আমাদের খুব লজ্জা হয়, আমরা খুব অপমানিত হই, তাতে আমরা কান্দি, কেউ কেউ আত্মহত্যা করি। সেই আত্মহত্যা দেইখাও পুরুষতান্ত্রিক বড় আপারা জ্ঞানের বাণী দেন, ‘নষ্টামী করলে এমনই হয়!’ সপ্তম শতকে বাই শি বইলা একজন বড়-আপা সুলভ পুরুষতান্ত্রিক ভদ্রমহিলা ‘ন্যায়পরায়ণ মেয়েদের ৭৯তম আত্মজীবনী’ বইয়ে লিখছিলেন, “নারীত্ব হইলো দয়াশীলতার ভিত্তি, নিজের জীবন দিয়া নিজের সতীত্ব ধইরা রাখা হইলো পবিত্রতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার স্বাক্ষর!’ হিহি, কী কইলেন? সতীত্ব? সেইটা কী জিনিস? খায় না মাথায় দেয়? খাড়ান, একটু হাইসা লই!

Nadia Edited
নাদিয়া ইসলাম

প্যাটেরনারি আনসার্টেইনটি এই যুগে আর নাই। ডি-এন-এ ফি-এন-এ টেস্ট পর্যন্ত যাইতে হয় না, একজন মেয়ে এখন কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহারের মাধ্যমে ‘কার’ বাচ্চা ‘কখন’ পয়দা করতেছেন, তার হিসাব এখন সহজেই রাখতে পারেন। সুতরাং, পুরুষের বহুগামিতার পাশাপাশি মেয়েদের বহুগামিতা এবং নিজেদের সেক্সুয়ালিটি চর্চায় বায়োলজিক্যাল আর কোনো বাধা নাই। পুরুষতন্ত্রের জাইনা রাখা ভালো, মানুষ এখন শুধু বাচ্চা পয়দা করার জন্য শুইয়া থাকেন না। পুরুষ যেই ফূর্তি এতশ’ বছর যাবৎ কইরা আসতেছেন সগৌরবে, সেই একই ফূর্তি মেয়েরাও প্রকাশ্যে করলে সমাজ এখন আর ভাইঙ্গা পড়বে না। ইন্টারনেট ও বিশ্বায়নের এই যুগে মানব সমাজ ভাইঙ্গা গুড়া-গুড়া হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাও নাই।

তাই নিয়ানডারথাল পুরুষ ও পুরুষের চাকর পুরুষতান্ত্রিক অশিক্ষিত হিংসুটি মেয়েগণ, আপনারা স্লাট-শেইমিং করতে থাকেন, আমারে বেশ্যা বানান, আমারে নিয়া আড়ালে ফিস-ফাস করেন, আমারে ঠিকমতো কাপড় পরাইতে লাইনে খাড়ান, আমি ক্যানো চাকরি করি, আমি ক্যানো পি-এইচ-ডি করি, আমি ক্যানো দুনিয়ার ৭ বিলিয়ন মানুষের বাচ্চার মাঝখানে আরেকখান বাচ্চা পয়দা করি না, আমি ক্যানো ডিভোর্স দেই, আমি ক্যানো পঞ্চাশ হাজার পুরুষ ও নারীর সাথে শুই, আমি ক্যানো জোরে হাসি, আমি ক্যানো রাস্তায় ঠ্যাং ছড়াইয়া বসি, আমি ক্যানো বুক ঢাকতে ওড়না লাগাই না, আমি ক্যানো একলা বাচ্চা মানুষ করি, আমি ক্যানো একলা বাসায় থাকি, আমি ক্যানো আমার বাসায় একাধিক পুরুষ নিয়া আসি, তা নিয়া কানতে কানতে গবেষণা করতে থাকেন, আমার কিছু যায় আসে না! আমি আমার শিক্ষাগত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং আমার সেক্সুয়ালিটিরে ব্যবহার করার সাহস নিয়া আপনার ভয় পাওয়া দেখি, আমি যা করতে পারি, আপনার তা না করতে পারার ঈর্ষা দেখি, আমার প্রেম ও যৌন জীবনরে উপভোগ করতে পারার যোগ্যতা নিয়া আপনার পশ্চাদ্দেশ জ্বলা দেখি, ব্যাভিচারের তকমা লাগাইয়া আক্তার জাহান জলিরে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করতে বা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদারে খুন কইরা আপনারে নিজের অপরাধ ঢাকতে দেখি, নিজে পরকীয়া কইরা যার সাথে পরকীয়া করতেছেন তার নামের সাথে দ্বিচারিনী ট্যাগ জোড়া দিয়া আপনারে দুই ঠ্যাঙ্গের মাঝখানে কিঁউকিঁউ কইরা ল্যাঞ্জা গুটাইতে দেখি, ধর্ষিতার কাপড় নিয়া প্রশ্ন তুইলা নিজের দোষ ঢাকতে দেখি, আপনার বুক জ্বলা কমাইতে এন্টাসিড খাওয়া দেখি, আর-

হাসি। হিহি হিহি হিহি।

সো, মানে সুতরাং- সমাজের বিবেক ভাইয়া এবং আপাগণ, আপনাদের আমি বাংলাদেশের বেশ্যাকরণ প্রকল্পের প্রেসিডেন্ট বানাইলাম। কনগ্রাচুলেশানস। এখন নাচেন।

আর তা না চাইলে স্লাট-শেইমিং বন্ধ করেন। কারণ, বেশ্যা তকমায় ভয় এবং লজ্জা পাওয়ার দিন মেয়েদের আর নাই। আর নাই। লজ্জা এখন আপনার এবং আপনাদের পাওয়ার দিন। তাই আপনাদের জন্য ভালোবাসা!

শেয়ার করুন: