আপোসের জীবনে দাহ তোমার শেষ হবে না, নারী

সাদিয়া নাসরিন: সতীদাহ শেষ হয়নি এখনো। তুমি সতী হও বা অসতী, তোমাকে পুড়তেই হবে অনলে। যে জীবনে তুমি কন্যা, যে জীবনে জায়া, যে জীবনে জননী…নিয়ন্ত্রণের চন্দন কাঠ আর আপোসের কেরোসিনে তোমার দাহ হবে আমরণতুমি পুড়বে যদি তুমি জীবন বোঝো। তুমি কয়লা হবে যদি তুমি জীবন খোঁজো। তুমি ভস্ম হবে যদি তুমি প্রতিরোধ কর। তুমি ছাই হবে যদি তুমি প্রতিবাদ কর।

sadia-11
সাদিয়া নাসরিন

তোমাকে জীবন-মরণতক নিয়ন্ত্রণ করবে পুরুষ। নিয়ন্ত্রণ করবে কখনো পিতা, কখনো স্বামী, কখনো সন্তান, কখনো বন্ধু। তুমি নিয়ন্ত্রিত হবে, তুমি আপোস করবে। তুমি যদি সস্তার তেল-সাবানে জীবন বিকিয়ে দেয়া “মেয়ে মানুষ” হও, তবে এই আপোস তোমাকে স্বস্তি দিবে, তুমি নিরাপদে থাকবে। তুমি প্রতিরাতে ধর্ষিত হয়ে ভোরে উঠে পবিত্র স্নানে শুদ্ধ হয়ে আর একটা নিরাপদ ধর্ষণের জন্য অপেক্ষা করবে। নিজের চামড়া অন্যকে বন্ধক দিয়ে রেখেছো তুমিতোমাকে নিয়ে আমার তেমন কিছু বলার নেই।

কিন্তু নিজের জীবন নিজের হাতে রাখা মেয়ে, তোমার দহন আমি বুঝি। নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি নেই তোমারও। তুমি রোজগার করবে? করতে পারো। তবে পা টিপে টিপে, গা বাঁচিয়ে, পুরুষের ছোয়াঁচ এড়িয়ে। তুমি কোন পেশায় যাবে সেই সিদ্ধান্ত তুমি নেবে না। তোমার পেশা, তোমার রোজগার নিয়ন্ত্রণ করবে পুরুষ। তোমার বুদ্ধি, মেধা নিয়ন্ত্রণ করবে পুরুষ। তোমার সঙ্গ, তোমার আনন্দ নিয়ন্ত্রণ করবে পুরুষ। তোমার কাম, যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করবে পুরুষ। তোমার পোষাক, পছন্দ-উল্লাস-বেদনা-ভাষা, স—ব, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক পুরুষ। পুরুষ তোমার বিধাতা, তোমার প্রভু। পুরুষতন্ত্রের বাদশা সে, সুলতান সুলেমান।

তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে পুরুষ পরিবারের নামে, মাতৃত্বের নামে, সমাজের নামে, চরিত্রের নামে, বিজ্ঞানের নামে, সভ্যতার নামে, ধর্মের নামে, ধর্মগ্রন্থের নামে, ঈশ্বরের নামে। তোমার জীবনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়া ছাড়া পুরুষের আর কোনো উপায় নেই টিকে থাকার। কারণ, তোমাকে তার বড়ো ভয়। তুমি তো তেল সাবানে বিকোও না। বেবী, জানু আর লাভিউ’র প্রতারণায়ও তোমাকে ভুলানো কঠিন। মিথ্যা স্তব আর সস্তা ফ্লাটারিতে তোমাকে ভাসানো যায় না। তোমার মতো জীবনের আলো চিনে ফেলা মেয়েদের কাছে বড় অনিরাপদ তোমার ওই বিধাতা পুরুষ। নিয়ন্ত্রণের এই জীবন থেকে তোমার মুক্তি নেই, নারী।

তুমি ভেবেছো তুমি অনেক এগিয়েছ নিজের যোগ্যতায়? না, এগিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা তোমায় দ্যায়নি পুরুষ। তুমি ঠিক ততটুকুই এগিয়েছো, যতটুকু পুরুষ তার সুবিধামতো চেয়েছে। পুরুষ নিরুপদ্রব শান্তির জীবন চেয়েছে বলে তুমি মহলে থেকেছো। পুরুষ যখন শিক্ষিত চৌকশ “বউ” চাইলো, তখন তুমি শিক্ষিত হয়ে বিয়ের বাজার দখল করেছোপুরুষ একা রোজগারে পেরে উঠছে না বলে রোজগার করে সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছো। পুরুষের ক্ষমতার রাজনীতিতে নারীর প্রয়োজন হলো, তাই তুমি শীর্ষপদে নারী শক্তির মহড়া দেখতে পেলেপুরুষের বিনোদন প্রয়োজন হলো, তুমি শিল্প-সংস্কৃতি মাতিয়ে রেখেছো। পুরুষ ঘরের যৌনতায় হাঁফিয়ে উঠেছে, তুমি পর্নো মডেল হয়ে তার সম্ভোগ বাড়িয়েছো।

তুমি সমতার কথা শিখেছো বুঝি? সমান অধিকারের কথা বলো? বেশ, কিন্তু প্রয়োগ করতে যেও না। বরং আপোস করো। তুমি যেহেতু বাইরে যাও, যেহেতু তুমি নিজের পাতের ঝোলটা নিজেই টেনে নাও, সেহেতু তোমাকে আপোস করতে হবে বৈকি!! কারণ তোমার আছে আস্থা অর্জনের দায়, বিশ্বাস রক্ষার দায়। তোমার সামনে মহান মাতৃত্বের গৌরব, সতীত্ব প্রমাণের চ্যালেঞ্জঅতএব, তাই তুমি আপোস করে যাও শয়নে, সমরে, প্রজননে। তুমি খাবার টেবিলে আপোস করবে, বিছানায় আপোস করবে, প্রেমে আপোস করবে, ঘৃণায়ও আপোস করবে।

নিজেকে ভোলাতে কখনো তুমি বলবে কৌশল, কখনো বা প্রতিরোধ। যে নামেই ডাকো না কেন, আপোস তোমাকে করতেই হবে। পুরুষের আধিপত্য মেনে নিতেই হবে তোমাকে। কারণ, পুরুষের রচিত বিধান তাকে দিয়েছে তোমার উপর আধিপত্য করার নিরঙ্কুষ ক্ষমতা। তোমার নিজস্বতা, তোমার স্বকীয়তা তো স্বীকারই করেনি কখনো তোমার বিধাতা পুরুষ। পুরুষ তোমাকে মূল্য দিয়েছে কেবল তোমার শরীরের জন্য, তোমার সেবা-যত্নের জন্য, তার পায়ে নিঃশর্ত সমর্পণের জন্য। সুতরাং তুমি পরাজিত হতে থাকো দাঁতে দাঁত চেপেআর একেই নারীর পরাজয় বলে পুরুষ তার আধিপত্যের আস্ফালন করতে থাকুক তুমি শস্যক্ষেত্র হও, পুরুষ চাষ করুক, বিচরণ করুক যখন ইচ্ছা।

পুরুষতন্ত্রের ষড়যন্ত্র আর লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে থেকে তুমি বরং ব্যস্ত থাকো নারী দিবস, নারী ক্রিকেট, নারী ফুটবল, নারীনীতি, নারীমঞ্চ, নারীজগৎ নিয়ে। তুমি একদিন বেগুনি রঙে সেজে নারী দিবস পালন করে সুখি হও। বাকি ৩৬৪ দিন পৌরুষিক গৌরবে গৌরবান্বিত পুরুষ সাজিয়ে রেখে দিক তোমার আপোসের জীবনের দাহ উদযাপনের জন্য সব দিনই যখন তার, সব কিছুই যখন তার, বিশেষ কিছুর আর দরকার কী থাকতে পারে পুরুষতন্ত্রের একেশ্বরের? পুরুষের চিরকালের যে পৌরুষিক গৌরব, সে তো তার প্রভুত্বের। তুমি নারী তার পুজারী বৈ তো কিছু নও! সুতরাং পুজারী হওপুজা দাও, সিজদা করো, অঞ্জলী দাও। পুরুষ সুখি হোক, তুমি স্বস্তি পাও।

আজন্ম বৈষম্যপীড়িত নারী তুমি বিজ্ঞান জানো না, সাহিত্য জানো না, ধর্মও জানো না!! পুরুষের দয়া-দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকা অশিক্ষিত নারী তাই আইনস্টাইন হয় না, নজরুল হয় না, এরিস্টটল হয় না, পিকাসো হয় না। নারী কখনো ধর্মাবতার হয় না, এমনকি ধর্ম গ্রন্থের অনুবাদকও হয় না। নারী যদিও বা কদাচিত সিমোন দ্য বেভোয়ার হয়, কখনো কমলা ভাসিন হয়, ভুঁইফোড় তসলিমা নাসরিন হয়, সে নামে অনেক বিতর্ক আর নিন্দা জড়িয়ে থাকে। তাঁদের মতবাদকে বিতির্কিত করা হয়,‘অনৈতিক’ বলে নিষিদ্ধ করা হয়।

সুতরাং আপোস করো নারী, মেনে নাও পুরুষতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণসহ্য করতে পারছো না? অপমানে নীল হয়ে যাচ্ছো? ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছো? তবু তোমাকে আপোস করতেই হবে। তা না হলে তোমার উপর নেমে আসবে পুরুষতন্ত্রের খড়গ। তোমার ঘর ভাঙ্গবে, সমাজ হারাবে। তুমি বিতর্কিত হবে, নিন্দিত হবে, বিতাড়িত হবে এবং  নিষিদ্ধ হবে। তার চেয়ে ভালো, তুমি নিয়ন্ত্রিত হও। নিষিদ্ধ হয়ো না।  

আর যদি দম থাকে, যদি তেজ থাকে, যদি মায়ের বেটি হও, ঘুরে দাঁড়াও। চোখে চোখ রাখো। চ্যালেঞ্জ করো। কথা বলো। ঝুঁকি নাও। প্রবল শক্তিতে, তাচ্ছিল্যে, অবজ্ঞায়, উন্নাসিকতায় চুরমার করে দাও নিয়ন্ত্রণকামি, উদ্ধত পুরুষ ইগোর তকত-এ-তৌসলণ্ডভণ্ড করে দাও অহঙ্কারী পুরুষতন্ত্রের ওই ফাঁপা সাম্রাজ্যবাদ।

সেইদিন আমার মাথা নত হবে তোমার চরণধূলায়।  

লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ

 

শেয়ার করুন: