মাটি ভিন্ন, তবে টিজিং একই

শারমীন জান্নাত ভুট্টো: তোরা অনেক ভাগ্যবতী, বিদেশে আছিস বলে ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয় না বলে মনে করছিলো দেশে থাকা আমারই এক বাল্যবন্ধু। তার মতে, যেসব মেয়ে বিদেশে পড়তে কিংবা ঘরণী হয়ে যায় তাদের আর অন্য যে কষ্টই করতে হোক না কেনো রাস্তাঘাটে লোকজনের অশ্লীল কথাবার্তা হজম করতে হয় না। আমার এ বান্ধবীর ধারণাটা ভুল প্রমাণ করতে আমার মাত্র ৫ মিনিট সময় লেগেছিলো সর্বোচ্চ।

বলে রাখা ভালো, বিদেশের মাটিতে বাঙালী মেয়েরা স্বদেশীদের দ্বারাই বেশী ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তো আমার কথা….কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরলে আপনাদেরও হয়তো আমার ওই বান্ধবীর মতো ভুল ভাঙতে সময় লাগবে না।

bhutto
শারমীন জান্নাত ভুট্টো

ঘটনা ১. ২০১০ সালের জানুয়ারীতে পড়ালেখার তাগিদে লন্ডনের মাটিতে পা রাখে সুমী ইসলাম (ছদ্মনাম)। ধীরে ধীরে নতুন পরিবেশ আর সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। একা একা বাসে, ট্রেনে করে যখন নতুন জায়গা চেনার আপ্রাণ তাগিদ, ঠিক তখনই একদিন বাসস্ট্যান্ডে এক পঞ্চাশোর্ধ্ব বাঙালী ভদ্রলোক (যদিও পোশাক-আশাক তাকে দেখে প্রথমে তাই মনে হচ্ছিল) পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো সুমী বাঙালী কিনা এবং তার সাথে আনুষঙ্গিক প্রশ্ন, কবে বৃটেনে আসা হলো, কোথায় থাকা হয়, কী করা হয়, পড়ালেখার খরচ কে চালায় ইত্যাদি।

নেহায়েত ভদ্রতা দেখিয়ে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া হচ্ছিল, আর মনে মনে সুমি ভাবছিলো, বাঙালীরা আসলেই অনেক সহজ-সরল আর অনেক অতিথিপ্রিয়, খুব সহজেই অপরিচিত কাউকেও আপন ভেবে কথা বলা শুরু করে। তবে তার এ ধারণার ওপর বাজ পড়তে বেশীক্ষণ লাগেনি যখন ওই তথাকথিত ভদ্রলোক হঠাৎ করেই বলা শুরু করলো তার স্ত্রী বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ, তাই এমন কাউকে খুঁজছেন যে কিনা তার স্ত্রীর সেবা করবে।

তবে এখানেই থামলে সুমি হয়তো অন্য কিছু ভাবতো না যখন ওই লোক একনাগাড়ে বলা শুরু করলো যে সে সুমীর ভিসা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে যদি কিনা সুমী ওই লোকটির স্ত্রী এবং তার সেবা করার দায়িত্ব কাঁধে নেয় এবং ওই লোক আর কাউকে এ কথা জানাবে না।

সুমী লোকটির কথার অর্থ বুঝতে পেরে এতোটাই অবাক হলো যে সেকেন্ডের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলো। সে শুধু লোকটিকে একটা কথাই বললো, আমি আপনাকে আমার বাবার বয়সী ভেবে কথা বলা শুরু করেছিলাম, কিন্তু ভুলটা ভাঙতে খুব একটা বেশী সময় লাগেনি। আফসোস আপনার ছেলেমেয়েরা সারাজীবন অজানা ভুলের মধ্যে দিয়েই তাদের জীবনটা নিয়ে যাবে।

এ কথা শোনার পর লোকটি উল্টো কিছু অশ্লীল শব্দ সুমির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে হাওয়া হয়ে গেলো। হতভম্ব সুমি নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বাস চেপে ফিরে এলো বাসায় আর ভাবতে লাগলো, ভিনদেশে এসেও এভাবে টিজিংয়ের শিকার হতে হবে তাও আবার নিজেদের গোত্রের কাছ থেকে, তা ছিলো রীতিমতো কল্পনাতীত।

ঘটনা ২. মিনা বিনতে আবদুল্লাহ গত চার বছর ধরে আছে ব্রিটেনে শিক্ষার্থী হিসেবে। এরই মাঝে শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়ে কাজ করছে বাঙালী একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ পাঠক হিসেবে। বেশীর ভাগ সময়ই শাড়ি পরে পর্দার সামনে উপস্থিত হতে হয়, আর লাইভ নিউজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে প্রায় রাত ১১টা বাজে। যদিও লন্ডনের জন্য রাত ১১টা তেমন একটা বেশী রাত না। কারণ এখানে নারী-পুরুষ সবাই রাত ১২-১টার দিকে বাড়ি ফেরে কাজ শেষ করে।

বাঙালী অধ্যুষিত বেথনাল গ্রীন এলাকায় ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ করে পেছন থেকে এক লোক ডেকে উঠলো, বাঙালী নি, এখটু দাঁড়ান? কথা শুনে মিনা বুঝলো লোকটি বাঙালী সিলেটি এবং কোন হেল্পের জন্য হয়তো দূর থেকে ডাকাডাকি করছেন। মাথায় কালো টুপি আর আলখাল্লা পরিহিত দাঁড়িওয়ালা লোকটি যার দুহাতে দুটি সদাইপাতির ব্যাগ, মিনার কাছে এসে জানতে চাইলো, সে ওখান থেকে কিভাবে হোয়াটচ্যাপেল বাসে যাবে। মিনা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলো কিভাবে বাস কিংবা ট্রেনে লোকটি যেতে পারবে। ব্রিটেনে এই ভদ্রতা মোটামুটি সবাই দেখায়, বিশেষত অপরিচিত কাউকে রাস্তাঘাট কিংবা ট্রেন স্টেশন চিনিয়ে দেয়া বা ডিরেকশন দেয়া। আর সেকারণেই মিনা সময়ের তোয়াক্কা না করে অচেনা বাঙালী লোকটিকে উপকারের হাত বাড়িয়ে দিলো।

এরপর লোকটি ধন্যবাদ দিয়ে মিনার কাছে জানতে চাইলো সে কোথায় যাবে, কার সাথে থাকে আর কোথায় কাজ করে। যদিও এধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রত হয়ে মিনা যেই আবার হাঁটা শুরু করলো, পেছন থেকে লোকটি বলা শুরু করলো, নিবি কতো, আমার লগে চল, শাড়িতে হেব্বি লাগতেছে………এই ধরনের অশ্লীল কথাবার্তা।

মিনা জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো, ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু কল দ্যা পুলিস রাইট নাউ, ইউ বাস্টার্ড। সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে থাকা পথচারীরা ছুটে আসলো মিনার কাছে, আর মুহুর্তের মধ্যেই লোকটি দৌঁড়ে পালিয়ে গেলো ভীড়ের মধ্যে। উপকার আর ভদ্রতা করতে গিয়ে তার মাশুল প্রায় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে মিনা সেদিনের ঘটনাতে।

আসলে কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। যার যেরকম স্বভাব সে যেখানেই থাকুক না কেনো তার প্রতিফলন সে ঘটাবেই। তাই পুরুষ শ্রেণীর ওই মানুষগুলো তাদের গায়ের ময়লা চাইলেই ঝেড়ে ফেলতে পারে না। বলে রাখা ভালো, প্রতিনিয়ত এরকম শ শ ঘটনার শিকার হচ্ছে ব্রিটেনে পড়তে আসা বাঙালী শিক্ষার্থীরা।

রাস্তাঘাটে চলাফেরা থেকে শুরু করে কাজের জায়গা এমনকি হাউসমেটদের তীর্যক বাক্য থেকেও নিস্তার পাওয়া কষ্টকর এবং হরহামেশার ঘটনা। তবে কেউ কেউ এসব টিজিংয়ের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ সোচ্চার করে আর কেউবা সয়ে যায় নীরবে নিয়তির নির্মম পরিহাস ভেবে। তবে এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে যতটা সচেতন ঠিক তার বিপরীত চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে বউ হয়ে আসা অল্পবয়সী তরুণীদের ক্ষেত্রে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.