ফাতেমা জোহরা: ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’– কলেজের ১ম বর্ষে সঞ্জীব স্যারের বলা চর্যাপদের পদগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। অতোটা তখন বুঝতাম না। মুক্ত, স্বাধীনভাবে স্কুল কলেজ অতিক্রম করেছি, সহপাঠীদের কখনো পুরুষ মনে হয়নি। সুতরাং নিজেকে হরিণ ভাবার অবকাশ ছিলো না। সুচিত্রাপ্রেমী আমার মা- খালা আর বোনদের পোশাক দেখতাম কত আপ – টু – ডেট। তারা স্লিভলেস ব্লাউজ আর জামা পরতো, আর হিন্দী ছবির অনুকরণে টাইট- ফিটিংস জামা পরতো ওড়না ছাড়া। এখন কি তা আমরা ভাবতে পারি? তখন খুব অভ্যস্ত চোখ ছিল এসবে।

ছোট্ট একটা উদাহরণ :
ওরশ উপলক্ষে গ্রাম্যমেলা, বাবাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। বাবার চ্যালা- চামুণ্ডা কম ছিল না, মা বলল- আমিও যাবো। বাবার শার্ট – প্যান্ট পরে উপরে বিশাল এক কাশ্মীরি শাল জড়িয়ে চ্যালাদের দলে ঢুকে গেল মা। মাজারের সামনে বসে সবার সাথে তবরুক খেল, সারা মেলা ঘুরে এলো। কই মাকে তো সমাজের অনুশাসন ভঙ্গকারী বা নারীবাদী কেউকেটা কিছু বললো না? সবাই মায়ের এই আচরণটায় অভ্যস্ত ছিল। আমার মাকে সবাই শ্রদ্ধাও করতো। যেটা আমার মায়ের সময়ে সম্ভব সেটাই আজ কেন অসম্ভব ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে? হয়তো বাবার মতো একজন পুরুষ দরকার আমাদের নারী হতে?
আমাকে যদি বলা হয় পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে,আমি পুরোপুরি একমত হব না।আমরা মেয়েরাও পুরুষতান্ত্রিকতার সহযোগী হয়ে যায় অনেক সময়।আমাদের দুর্বলতা আছে ভালবাসার, আশ্রয়কাতরতার আর ধরত্রী সর্বংসহা হবার মত সহ্যক্ষমতা। এই দুরবলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে নিজেকে হরিণ ভাবার অবকাশ থাকবে না।
আমার কয়েকজন বন্ধু ও রিলেটিভ আছেন, যারা ডিভোর্সি ও স্বামী মারা গেছেন। এর পরের জীবনকে তারা সন্তানের জন্য উৎসর্গীকৃত মনে করেন। আমি এই ধারণাকে একদম নাকচ করে দিই। কিছুদিন আগে স্বামী মারা গেছেন এমন এক রিলেটিভ (আমার বয়সী) আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেন- আপনি তো বুঝবেন একজন নারীর অতৃপ্তি, আমার স্বামীর কাছে আমার চাহিদা ছিল প্রবল। আমি কিছুই বলতে পারি নাই উনাকে, সাহস হয়নি বলতে আর একটিবার নিজের জন্য চিন্তা করুন। এটা যে পাপ!
কিন্তু আমি এমন একজনকে জানি যিনি চেয়েছিলেন বলে দ্বিতীয় জীবনটা অর্থময় করে তুলেছেন। তারা ভাবী- এক সাহসী মহিলা, দুঃখীও বটে। পঞ্চাশোর্ধ বয়স, এক্সিডেন্টে স্বামী আর পুত্রকে হারিয়েছেন। একমাত্র মেয়ে, মেয়েকে বিয়ে দেবেন। একা মা কীভাবে থাকবেন? সমাধান তো তৈরি এ সমাজের, মেয়ের কাছেই থাকবে। প্রচণ্ড আত্মসম্মান বোধ ছিল তারা ভাবীর, মেয়ে মাকে বুঝতো, সে নিজেই উদ্যোগী হয়ে মাকে বিয়েতে রাজী করালো। মেয়ের বিয়ের পর মায়ের বিয়ে হলো। নতুন জীবনে তিনি একজন সফল, দায়িত্ববান এবং সুখী মানুষ।
আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিত্বে আস্থা রাখি, দায়িত্ববোধে সচেতন থাকি, সময়কে বুঝতে পারি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রতিকূলতা তো থাকবে, কোথায় নেই প্রতিকূলতা?
আজ হিলারিকে তার প্রথম ডিবেটে নারী বৈষম্যের ইস্যুটি তুলতে হচ্ছে। সঞ্চালক নারী প্রার্থীদের নাকি কঠিন ও বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। আর ট্রাম্প হিলারিকে বিব্রত আর নাজেহাল করার জন্য ক্লিন্টনের এক্স গার্লফ্রেন্ড জেনিফার ফ্লাওয়ারকে বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে বসার ব্যবস্থা করবেন। এই যদি হয় অবস্থা, আমরা তো তৃতীয় বিশ্বের নারী।
অনেক পথ– খান — খন্দক — সাগর — মহাসাগর পেরুতে হবে। এখানে নিত্য মরিয়মরা সহিংসতার শিকার, ডালিয়ারা আত্মহননের পথ বেছে নেয়, শেলীরা এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়, হবে, হতেই থাকবে।
আমরা অগ্রগতির কথা বলি। অগ্রগতির সমস্ত পরিসংখ্যান শুকনো পাতার মতো উড়ে চলে যায় শেলী, ডালিয়া, মরিয়মদের আর্তকন্ঠের চিৎকারে। তাই মুক্তকচ্ছ হয়ে নারীবাদী নারীবাদী আওয়াজ না তুলে আমি সকল বাবাকে, স্বামীকে, বন্ধুকে,,ভাইকে, সন্তানকে বলি- এই শ্বাপদসংকুল অরণ্যে তোমার মা, মেয়ে, স্ত্রী, বোন,বন্ধু অরক্ষিত হরিণ শাবক। বাঘেরা শিকারের অপেক্ষায়! এসো তাদের পাশে থাকো, তাদের হাতে হাত রাখো, তাদের নেপথ্যচারিণী করে রেখো না, অগ্রবর্তী হয়ে এগিয়ে দাও। আমাদের যৌথ উদ্যোগ হোক সফল, সুন্দর,নয় নারী – নয় পুরুষ, সমতাভিত্তিক এক সমাজ বিনির্মাণের প্রক্রিয়া।
মনেই থাকে বৈষম্যের বীজ। সে বৈষম্য যেমনই হোক। প্রশ্ন হলো – মনে কখোন কোথা থেকে এই বীজের বপন শুরু হয়? বীজ থেকে মহীরুহে রুপান্তরিত হয় কখোন? মনের জমিন থেকে এই বিষবৃক্ষের উৎপাটন সম্ভব কিনা? সম্ভব হলে কখোন তার উপযুক্ত সময়?
আমরা কেউ মন নিয়ে জন্মাই না। আমাদের মন আস্তে আস্তে তৈরী হতে থাকে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈষম্য মূলক আচরণ দেখে-শুনে-শিখে আমাদের মনও বৈষম্যে বিশ্বস্ত ও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । সে কারনেই, নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিষয়ে, সিমন বলেছেন, “কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে”। ফলত একজন ‘নারী’ও পুরুষতান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত ও বিশ্বস্ত হয়ে যায়।
আপনার মা’ এঁর সময়ে হয়ত সমাজের মন অন্যরকম ছিলো তাই তিনি (তাঁরা) পেরেছিলেন। হয়ত এখনকার সমাজের মন অন্যরকম তাই আজকের মায়েরা সাহস হারিয়ে ফেলেছেন। হয়ত মেয়েদের / মায়েদের অনেকে নিজেরাও নিজের যে একজোড়া পাখা আছে, তাতে ভর দিয়ে উড়ে বেড়ানো যায়, জীবনের আকাশে ভেসে বেড়ানো যায় – তা ভুলেই গেছেন। নইলে একজন চিত্রনায়কের “চেহারায় যথা পরিমাণ পৌরুষ নেই” নায়কের ছবি সহ এমন একটি ফেবু স্ট্যাটাসে কেন অনেক নারী ‘লাইক’ দেন, সহমত হন?
শেষ প্যারাগ্রাফটা না থাকলেই ভালো হতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই আকুতি লেখককে মানাচ্ছে না।
খুব সুন্দর লিখেছেন লেখক। তার এই মন্তব্যটি বিশেষভাবে ভালো লেগেছে যে..’আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিত্বে আস্থা রাখি, দায়িত্ববোধে সচেতন থাকি, সময়কে বুঝতে পারি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রতিকূলতা তো থাকবে, কোথায় নেই প্রতিকূলতা?’….আশা করি নিয়মিত লিখবেন। ধন্যবাদ।