জীবনের টুকরো গল্প-৪

সাকিনা হুদা: মল্লিকার হাঁটতে একটু কষ্ট হয় আজকাল। হাঁটুতে ব্যাথা। কদিন থেকে পায়ের পাতা দুটো ঝিমঝিম করে। রাতে ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে কোমড়েও বেশ ব্যথা হয় অনেক রাতে। হট ওয়াটার ব্যাগটা নিলে বেশ লাগে। ব্যাথাটাও বেশ কমে। কিন্তু কাকে বলবে এত রাতে? তাই চুপচাপ শুয়ে থাকা।

অনুযোগের শেষ নেই। ‘তুমি কোনকালেই হাঁটতে পারো না’। অবাক চোখে তাকায় মল্লিকা। তাহলে এতগুলো সন্তান কীভাবে বড় হলো। হাটি হাটি পা পা।

Sakina Huda
সাকিনা হুদা

উত্তর দেয় না মল্লিকা। মল্লিকার বয়স এখন পাঁচাত্তর। রিকশায় উঠতে পারে না। আঁকাবাঁকা রাস্তায় হাঁটতে পারে না। ওভারব্রিজ পার হতে পারে না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হলে এক পা দু’পা করে ওঠে। এক্সিলেটরে তো মল্লিকার ভীষণ ভয়। মল্লিকার বড় অপরাধ এটা। মল্লিকার বয়সী কতজনাই তো যাচ্ছে তরতর করে। মল্লিকা কেন পারে না? এর ক্ষমা নেই। তাই মল্লিকা যেতে চায় না কারো সাথে। আসলে মল্লিকাকে সাথে নেয়া বিড়ম্বনা বৈকি।

মল্লিকার স্বামীর বয়স আশি। দিব্যি হেঁটে চলেন। কোন সমস্যা নেই। হাঁটতে তার জুড়ি মেলা ভার। আজো স্বচ্ছন্দ্যে পাহাড়ে ওঠা নামা করতে পারেন। বাজার হাটে যান। এক্সিলেটর বা সিঁড়ি তার কাছে কোন ব্যাপারই না। দু’চোখ অপারেশন করার পরও বই পড়েন দিনরাত। বাসে ট্রামে রিকশায় চলতে পারেন স্বচ্ছন্দ্যে। মল্লিকা তারই সহধর্মিনী। মল্লিকা দিনরাত ভাবে কেমন করে শক্তপায়ে হাঁটবো। এক্সিলেটরে উঠবো। সন্তান ও স্বামীর উপযুক্ত হবো কোনকালে, কখন! আজকাল আবার কখনো কখনো কারো সাথে বড্ড কথা বলে ফেলেন মল্লিকা। একটা ঘটনার সাথে আরেকটা ঘটনা জড়িয়ে যায়। অপরাধ তো কঠিনই বটে।

মল্লিকা জরায়ু কবে ফেলে দিয়েছে। গলব্লাডার অপারেশন করেছে। তারপর থেকে কতশত উপসর্গ। যখন তখন শরীর ঘেমে যায়। হাত থেকে জিনিসপত্র পড়ে যায় ঝমঝম। কিছুই মনে থাকে না। মল্লিকা শুধুই ভুলে যায়। কোথায় টাকা কোথায় চাবি দরকারি  জিনিসপত্র। অথচ কী আশ্চর্য! আশি বছরের স্বামীর সব মনে থাকে। বইয়ের প্রতিটি লাইন তার মনে থাকে। মল্লিকার মনে থাকে না। অতীতের মল্লিকার সাথে নিজেকে মেলাতে পারে না। বর্তমানটাই তার আসল অস্তিত্ব। এটিই সবাই জানে। মল্লিকার সন্তানেরা বাবার মতই পথ চলতে জানে। এক্সিলেটরে ভয় পায় না। সিঁড়ি টপকে যায় দমাদম। রাস্তাঘাট দোকানপাট সব নখদর্পনে। ওরা জীবনকে চেনে ওদের আয়নায়।

মল্লিকা শুধু পারে রাঁধতে। মল্লিকার খিচুরি ভারি মজা হয়। মল্লিকার হাতের নিরামিষ রান্না মল্লিকার স্বামীর কাছে অমৃত। সকালে গরম গরম পরোটা বা রুটি, সেইসাথে নিরামিষ মল্লিকার স্বামীর খুব প্রিয়। গর্ব করে বলেন, মল্লিকার হাতের রান্না খেয়েই তিনি এতো ভালো আছেন।

মল্লিকার অনেক কথা মনের কোনে ভিড় জমে। মল্লিকার স্বামী সংসারের কোন কাজেই কোনকালেই পারদর্শী ছিলেন না। অতি প্রয়োজনেও এক কাপ চা বা অন্য কোন সাংসারিক কাজ করতেও কখনো দেখেনি মল্লিকা। সন্তানদের তদারকিতেও তার কোন ঔতসুক্য বা প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেননি। তিনি ছিলেন বহির্জগতের। তার কর্মস্থলের সুযোগ্য কর্মকর্তা। দিন পাল্টেছে। এখন নিজের হাতে চা তৈরি করেন। সময় সময় সন্তানদেরও খাইয়ে খুশি করেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। রান্নাঘরের মেঝেতে, চারপাশে চা পাতা চিনি দুধের ছড়াছড়ি। বিস্কিটের টিন খোলা। সবকিছু ছড়ানো, উল্টানো।

নিজের ব্যাক্তি জীবনে যিনি এত গুছানো, তিনি কেন মল্লিকার কর্মক্ষেত্রে এত অগোছালো, এত অস্থির, এত উদাসীন! মল্লিকা ভেবে পায় না। মল্লিকার উত্তর জানতে ইচ্ছেও করে না। মল্লিকার সবচেয়ে কষ্ট হয়, যখন অতি পরিচিত জনের নাম ভুলে যায়। অনেক ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে। মল্লিকার মন সবসময় ভুলে যাবার আতঙ্কে অসহায়ত্বের যন্ত্রনায় বিমর্ষ থাকে। মল্লিকা চোখ অপারেশন করেছে। তবুও ভালো দেখতে পায় না। কানে কম শোনে। টেলিফোনেও সময় সময় শুনতে পায়না। সময় কাটানোর মাধ্যমগুলো একে একে সরে যাচ্ছে জীবন থেকে।

‘‌জীবন যায়, যেতে থাকে/ যেখানেই যাই, যে পথে বা যে বাঁকে দাঁড়াই/ যে ঘাটে বা যে হাটে/ বড় খালি খালি লাগে’। তসলিমা নাসরীনের এই কবিতার লাইনদুটি মল্লিকার বড় প্রিয়।

মল্লিকা ভাবে, কোথায় সেই মল্লিকা! যে গান গাইতো, আবৃত্তি করে মঞ্চ মাতিয়ে তুলতো, অভিনয় করতো, ভালো বক্তাও ছিল, সাইকেলে চড়ে ছোট্ট শহরটা একসময় ঘুরে বেড়াতো- সে তো অনেক অনেক দিন আগের কথা। সেই মল্লিকা আর নেই। হাঁটা চলায়, কথাবার্তায়, জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্তে সাধারণ, অতি সাধারণ, অতি পুরাতন, বেলাশেষের এক নগন্য ব্যর্থ মানবী মাত্র।

 

শেয়ার করুন: