আলফা আরজু: কয়েকদিন আগে অসম্ভব মেধাবী ও সফল একজন “সাংবাদিক” ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বললো – “আপা মইরা যাইতে ইচ্ছা করে”। আমি হতবাক, স্তব্ধ, নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু অবিশ্বাস নিয়েই প্রত্যুত্তরে বলি “কী বলো -এইসব বাজে কথা”।
আমার বিশ্বাস না হলেও – কিছু যাই আসে না। এই অসম্ভব শক্ত মানুষটাকে আমি যেইভাবে চিনি – এর সাথে যাই না – এই সব কথার। ওর কাছে থানা-পুলিশ-মন্ত্রী কোনো বিষয় না। কিন্তু ওর মনের অবস্থা খুব নাজুক সেটা বুঝি। ওর দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময়ের কষ্টের সফল সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার, আন্দোলন, মেধা, ভালো মানুষত্ব, ভালো মা, ভালো সন্তান, ভালো বোন-বন্ধু – সব কিছু আজ ওর কাছে অমূলক। একজন খুব কাছের মানুষ ওর আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের সংসার “সন্তান-ভালোবাসা-হাজারো হাসি-কান্নার” – সব কিছুই মিথ্যে।

বয়সে আমার ছোট হলেও আমি এই মানুষটাকে খুব পছন্দ করি – একনিষ্ঠ ভক্তও বলা চলে। ওর সব ভালো লাগে – ওর আত্মবিশ্বাস, ভালো কিছু করার আত্মপ্রত্যয়, সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতা, মেধা। আমি ওকে অনেক বছর চিনি (!), প্রায় ২০ বছর। কিন্তু আমার চেনা “শক্ত” সেই মানুষটা এইসব জিনিস নিয়ে মুষড়ে পড়তে পারে – কোনোদিন ভাবিনি।
আসলে – আমরা একজন আরেকজনকে যেইভাবে চিনি – সেটা কি আসলে চেনা? আমরা সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগের ক্লাসে যেতাম (পড়তাম বললে ভুল হবে!)। আন্তঃব্যক্তিগত যোগাযোগ বিষয়ে কম-বেশি ক্লাস করেছি (!) – কিন্তু পড়িনি কিছুই। এইজন্য মনে হয় – যাদের চিনি অথবা পরিচিত বলি – সেটা কতোটা সফল চেনা অথবা জানা – প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়।
আমার ব্যর্থতার দীর্ঘ লিস্টের মধ্যে “যোগাযোগের ব্যর্থতা” যোগ হলো এইবার। এখানেও আমি ব্যর্থ ভেবেই কষ্ট পাচ্ছিলাম। তবে এই দুঃখবোধটা একটু কমেছে – কয়েকদিন আগে একজন “সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ” বিষয়ক গবেষক ও শিক্ষকের লেখা পড়ে। কিছুদিন ধরে একটা দুর্ঘটনা আমাদের অনেকের কাছেই মনো:কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ সেটা প্রকাশ করছি স্ট্যাটাস দিয়ে, কেউ হয়তো নিভৃতে কাঁদছি, কেউ কেউ আবার গবেষণালব্ধ লেখা লিখে প্রশংসা পাচ্ছি। গবেষকদের মানুষ মনে করে আমরা ভুলও করছি অনেকে। ভুলে যাচ্ছি যে – গবেষকরা সবকিছুই Qualitative অথবা Quantitative অথবা Mixed Method এ ফেলে দিয়ে দেখেন। গবেষকেরা সবকিছুই critical analysis করেন।
উনাদের কাছে একজন অসহায় মায়ের আলাদা জায়গা নেই, একজন মানুষ কত কারণে অসহায় বোধ করতে পারে তা উনারা বুঝেন না। একজন মা কেন সন্তানকে “পুলিশ-আইনে”র কাঠগড়ায় (বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জায়গায়!) দাঁড় করাতে দ্বিধা করেন – উনারা এইসব বুঝেন না। একজন সৌখিন সফল মানুষ প্রতারিত হয়ে ভেঙে যেতে পারেন। যার লংটার্ম মানসিক ইফেক্ট থাকতে পারে। উনি বা উনারা জানেন না। তাই নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা চাই – একজন মানুষের করুণ চলে যাওয়াকে। জীবনের কিছু-প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষা করে না। তাই সাধারণ মানুষেরা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াই। উত্তরের অথবা সমাধানের পথটা সহজ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।
যাই হোক, “সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ” বিষয়ক গবেষক ওই লেখায় দুইজন মানুষের কথা লিখেছিলেন। যাদের তিনি চিনতেন ২৫ বছর (!)। কিন্তু উনি কি সফলভাবে “যোগাযোগ” করতে পেরেছিলেন? এই উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছে – উনিও ব্যর্থ হয়েছেন যোগাযোগবিদ হিসাবে। কারণ ২৫ বছর ধরে একটা মানুষ চিনি অথবা পরিচিত বললে – আমরা বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে যেই মাখামাখি হবার কথা – তা কিন্তু পাইনি। উনি “মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় আগ্রহ বরাবরই কম” বলে দাবি করেছেন। খুবই ভালো ও উঁচুমানের মানুষেরা এইসব করেন। অসাধারণ একটা বিষয় – আমারও ভালো লেগেছে। বাংলাদেশের মানুষরা একটু বেশি আবেগপ্রবণ ও সিম্প্যাথেটিক হয় – তাই জেনে এসেছি। কারোর সাথে প্রথম পরিচয়ে আমরা – বাড়ি কই থেকে শুরু করে বিবাহিত-অবিবাহিত সব জেনে ফেলি।
সেখানে একজন মানুষ পেলাম যিনি “privacy” অথবা “personal” বিষয়কে শ্রদ্ধা করেন (যদিও লেখার একটু ভিতরে প্রবেশ করলে – উনার এই দাবি মিথ্যে মনে হয় – বিশেষ করে উনি যখন গুজবে’র মতো বিষয়ের অবতারণা করেন!)
যাক – আমি এই “চেনা-জানা”র বিষয় নিয়েই থাকি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সুবাদে – আমরা এখন সবাই কম-বেশি সেলেব্রেটি জীবন-যাপন করি। এটা ভালো, কী মন্দ – যাচাই করার কোনো উপায় নেই। এটার কল্যাণে আমাদের ফলোয়ার ও ভক্তের অভাব হয় না। আমার কাছে এই জীবনটা খুব উপভোগ্যই মনে হয়। মানুষমাত্রই নিজেকে ভালোবাসে, অন্যের মনোযোগ চাই। তাই এই “মনোযোগে”র বড় একটা অংশ আসে যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে। বিশেষ বিশেষ মানুষের সাথে আমাদের সেলফি, একই ফ্রেমে সমাজের বড়ো বড়ো লোকজনের সাথে ছবি, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, ঘরের দামি-দামি আসবাবপত্র, হাজার রকমের পদ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ণ – অন্যের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে সহজেই ।
আবার বিশেষ বিশেষ মানুষকে “চিনি-পরিচিত” বললে আর পাই কে। অমুকের (!) সাথে সেদিন আড্ডা মারলাম, খাইলাম, অমুক (!) আমাকে ফোন দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। এইগুলা আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সুবাদে – পৌঁছে দেই দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অনায়াসে। কী দারুণ একটা জীবনের প্রতিচ্ছবি (নিশ্চয় সত্যি ওই সুন্দর হাসিগুলো, নাকি অন্যকিছু আড়াল করি!)।
আবার কেউ কেউ কষ্টে আছি আইজুদ্দীন (বাবার নাম!), দুঃখে প্রাণ যাচ্ছে, অসুখ করেছে, ঠাণ্ডা-সর্দি-জ্বর-মাথা-কার্ডিয়াক-জন্ডিস (STD অথবা HIV দেখি নাই এখনো!) ব্যথা কিছুই বাদ যায় না – আমাদের অনুভূতি প্রকাশের অন্য কোনো মাধ্যম না থাকলেও – একটা স্ট্যাটাসই (অবস্থা) যথেষ্ট। আমাদের মাথার কাছে মানবিক মানুষের ঢল নাম, কেউ আনারস-আনার-বেদেনা-বরই-হরলিক্স নিয়ে চলেও আসেন, কেউ ডাক্তারি শুরু করে দেন মন্তব্য দিয়ে। দারুন অনুভূতি – কত মানুষ আমার পাশে- ভাবলেই শান্তি। সেই বন্ধু, ফলোয়ারদের একটা মন্তব্যের জন্য অধীর আগ্রহে থাকি। কিন্তু যারা একই ঘরে থাকেন, এরা হয়তো জানেও না (!) – “আপনি অসুস্থ অথবা মন খারাপ”। আমরা আসলে যোগাযোগের এমন একটা লগ্নে – যেখানে আমাদের ব্যক্তিগত-সামাজিক-আর্থিক-পারিবারিক সব কিছু মিলেমিশে একাকার।
যাক “চিনি-পরিচিত”র প্রেক্ষাপটে যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের সামাজিক পারিবারিক জীবন উপস্থাপন নিয়ে আরেকটু প্যাচাল। এখানে আমরা সবাই এতো দারুণ দারুণ স্ট্যাটাস অথবা মন্তব্য করি যে আমাদের ভক্তকুলের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সহস্র থেকে হাজার, হাজার থেকে লক্ষ। আমিও অনেকের ভক্ত, ফলো করি, লাইক দেই, তাদের পোস্ট শেয়ার দেই। ভালো লাগে। ভালোবেসেই শেয়ার অথবা ফলো করি। কিন্তু, মাঝে মাঝে কষ্ট হয় – যখন শুনি “ওহ অমুক, ওহ তমুক” ওর সবকিছুই যোগাযোগ মাধ্যমকেন্দ্রিক। মানে কী? মানুষ যা না, তা কিভাবে করে, লেখে অথবা বলে?
উত্তর খুঁজতে আমার কষ্ট হয় – কারণ আমি খারাপ কিছু শুনতে চাই না। তাই কারও কারও বিষয় আমি জানতে চাই না। তাদের আমি অন্ধভাবেই ফলো করি। কিছু কিছু মানুষের পোস্টিং দেখে – অনেকেই ভিমড়ি খায়, ঢোক গেলে, কপাল চাপড়ায়, চুল টানে, কপাল কুচকায়। যেমন ধরেন – একজন নিম্ন আয়ভুক্ত মানুষ কিভাবে এতো জৌলুসময় জীবনযাপন করেন। এতো আর্থিক সচ্ছলতা কোথা থেকে আসে (মনে হয় – বাপ-দাদারা জমিদার ছিল!) কারও কারও ছবি দেখে মনে হয় – উনারা পানি আর মদ আলাদা করতে পারেন না (ওয়াসা’র জীবাণুযুক্ত পানীয়ের চেয়ে বিয়ার ভালো!) ।
কী জানি – আমাদের সমাজে কি আর নিম্নবিত্ত বলে কিছু নেই? আমরা সবাই পানির পরিবর্তে বিয়ার খাই, ষ্টার-প্লাস এর সিরিয়ালগুলোর মতো সারাক্ষণ সেজে-গুঁজে থাকি, মোনালিসা’র মতো হাসি-অথবা কাঁদি টাইপ হয়ে গেছি।
কারও কারও দেখি – “চেক ইন” দামি রেস্টুরেন্ট এ। আমি ভয় পাই – সেই যে “চেক ইন” করলো আর চেক-আউট দেখলাম না। ওরা কি সব সময় ওখানেই খাই-থাকে। ইশ কী দারুণ জীবন! রান্না-বান্নার ঝামেলা নাই – দামি দামি রেস্টুরেন্ট খাবার মজা। কেউ কেউ আবার দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই ছবি – বাহঃ কী দারুণ! আমাদের দেশে আর দুর্গন্ধময় হাসপাতাল নাই। ডাক্তার-নার্সরা কী সুন্দর হাসি হাসি মুখে সেবা দিচ্ছে। সত্যি ভালো লাগে বলছি।
যাক, আমরা আসলে একটা সুন্দর দুনিয়াতে বাস করছি – যেখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধমগুলোতে চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারি। এখানে কোনো দুঃখ-দুর্গন্ধ নাই, ঝামটা মারা নার্স-ডাক্তার নাই। আসলে আমরা যা চাই – যেমন জীবন চাই – তারই চিত্র এইসব। একটা আদর্শ জীবনব্যবস্থা। বৌ-শাশুড়ির অথবা ননদ-জা’দের কলহ নাই। বাপ-দাদার ওয়ারিশ নিয়ে সালিশ-বিচার নাই। সবাই সবার বন্ধু। সবাই হাসি হাসি মুখ নিয়ে স্মার্টফোনের বদৌলতে মেকআপ করা সেল্ফি তুলি। সত্যি দারুণ।
আজ সকালে প্রথম আলোর সাংবাদিক শরিফুল হাসানের একটা স্ট্যাটাস নিয়ে ভাবছিলাম। হাসান যেখানে আহ্ববান করেছে “যারা নিজেকে মানুষ মনে করেন সবার প্রতি অনুরোধ প্রাণীর জীবন থেকে বেরিয়ে একবার মানুষের জীবনটাও যাপন করে দেখুন। অামি অামিত্ব থেকে বেরিয়ে চলুন পরেরটাও একটু ভাবি। দেখবেন এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোথাও নাই।” – ওর লেখা আমার ভালো লাগে সেটা জনসম্পদ নিয়ে হউক অথবা কোনো এক মেধাবীর লড়াই। আমি ওর হাজার ভক্তের একজন। ওর স্ট্যাটাস সব থাকে “জীবনমুখী”। তাই হাসানের স্ট্যাটাস পড়ার পর থেকেই আমাদের সামাজিক মাধ্যমগুলোতে চিত্রায়িত জীবনে “চেনা-জানা” মানুষের জীবন নিয়ে ভাবছিলাম।
আসলে কাউকে চিনি না আমরা ! চেনা চেনা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াই মাত্র!
লেখক: সাংবাদিক, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।