সন্তানের হাতে মৃত্যুর নিয়তি তো আমরাই লিখেছি

সাদিয়া নাসরিন: ঐশী রহমান, ফারদিন হুদা মুগ্ধ…। ঐশী থেকে মুগ্ধ। এক সতের থেকে আরেক সতের। কারা ওরা? আমাদের কর্মফল? মধ্যরাতে বিকৃত যৌনতার নীল উল্লাসে মেতে উঠা ওই ছেলেমেয়েগুলো, ওরাই বা কারা? কেন আমার এতো চেনা লাগে ওই মুখগুলো! ওখানে কি আছে আমার কঙ্কাবতী? ডালিম কুমার? না না, তা কী করে হয়? কঙ্কাবতী আর ডালিম কুমার আমার সোনার ছেলেমেয়ে। ওরা আমার বুক জুড়ে থাকে, জড়িয়ে ধরে রাখে। আমার বুকের ওমে ঘুম ভাঙ্গে ওদের, ঘুমিয়ে পড়ে আমার বুকে।

তবে, কেন ওরা এমন মৃত্যু হাতে করে ছুটে আসে আমার দিকে, আমাদের দিকে? কেন, আমাদের দরজার এপাশে রেখে ওপাশে হারিয়ে যায় আট মিনিটের চোরাগলিতে? যে সন্তানের জন্য আমরা দশ দুয়ারী ভিখেরির মতো কুড়িয়ে কুড়িয়ে ভালোবাসা আর স্বচ্ছলতা জমিয়ে রেখেছিলাম, সেই স্বচ্ছলতার ছুরি আর আগুন কেন আমাদের রক্তাক্ত করে, পোড়ায়? তবে কী হিসেবে কোথাও ভুল ছিল?

ভুল তো হয়েইছিল। আমরা সন্তান জন্ম দিয়েই ভেবেছিলাম “মা” হয়ে গেছি। কিন্তু এই “মা” হওয়াটাই ছিল মস্ত বড় শুভঙ্করের ফাঁকি। সন্তান গর্ভে ধারণ করা, যথাসময়ে জন্ম দিলে সবাইমাবলে হয়তো।

Oishi 2কিন্তু মাতৃত্ব‘! তার যে অনেক দায়! মাতৃত্ব মানে প্রাণের সাথে প্রাণের প্রেম, প্রাণ থেকে প্রাণের শুরু…এ এক অপার্থিব জীবন আবেদন। এই জীবন আবেদনে সন্তানের প্রাণের সাথে আমার প্রাণ যোগাযোগ করতে না করলে কিসের মা হওয়া!

সন্তানের ভাষা বুঝতে না পারলে, সন্তানের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারলে, সন্তানের জন্য কোনও আদর্শ তৈরি করতে না পারলে আমার সন্তান “বখে” গেছে বলে বিলাপ করার কী মানে? সন্তানের হাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে এনে দিয়ে, দিনে আটশ টাকা হাত খরচ দিয়ে, কোন মাতৃত্বের বড়াই করি আমি? আমার বুকের ওম না পেয়ে ছেলে কোন সময় নেশার ওমে বুঁদ হয়েছে তা আমি জানতেও পারিনি! যখন জানলাম তখন আমার সন্তান আমার জন্য মৃত্যু পরওয়ানা এনেছে ভালোবাসার কফিনে।

হা জীবন !! হা নিয়তি !!!

এই নিয়তি তো আমরাই লিখেছি দিনের পর দিন ধরে। আমাদের অসততায়, অবহেলায়, উদাসিনতায়, দায়িত্বহীন বেপরোয়া ব্যস্ততায় কোন ফাঁক গলে আমাদের সন্তান চুরি হয়ে গেছে আমরা তো জানতেই পারিনি। আজকে আমরা শুধু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি কিছু শিরোনামের উপর।

শিরোনাম “সতের বছর”। সতের বছরের মুগ্ধ। স্কুল জীবন থেকেই নানা ধরনের বাজে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে মুগ্ধ। বাবা ঠিকাদার ও সেনেটারি ব্যবসায়ী ছেলেকে দেওয়ার মতো সময় কই তার? আর মা? একটা সতের বছরের ছেলে নেশা করছে, বখে যাচ্ছে টেরও পাননি। কিন্তু চাওয়ার আগেই ছেলের সামনে হাজির করেছেন আলাদিনের চেরাগ। চেরাগ ঘষলে পাঁচ লাখ টাকার বাইক মিলে, বন্ধু মিলে। কিন্তু “বাবা-মা” মিলে না, সোহাগ-শাসন মিলে না। চেরাগে নেশা মিলে, জীবন তো মিলে না। আহা, সেই জীবন পুড়িয়ে দাম শোধ করলেন পিতৃত্বের।

dsu-2শিরোনাম আঠার প্লাস আনসেন্সরড। একটি আট মিনিটের লিঙ্ক এবং ১ লাখ ২২ হাজার ছেলেমেয়ের পাশবিক যৌন উল্লাস এবং একটি আত্মহত্যা চেষ্টা। এই বিকৃত উল্লাসের আখড়াতে ভিড়েছে ১৬ থেকে আঠারো বছরের ছেলে মেয়েরা। জ্বী, মেয়েরাও। আমরা যাদের হাতে একটা দামী ডিভাইস ধরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমিয়েছি। আমরা জানি না, আমাদের সন্তানরা অগোচরে বাসে দাঁড়িয়ে নিরপরাধ সাধারণ মেয়ের ক্লিভেজ, বুক, পেট কিংবা ফেসবুকে পোস্ট করা ছবি চুরি করছে আর বন্ধ দরজার ওপাশে বসে পাশবিক যৌনতার নীলে ভেসে যাচ্ছে।

তবু আমরা দাবি করতে থাকি পিতৃত্ব আর মাতৃত্বের। আট মিনিটের ভিডিও’র নায়ক নিজের ঘরে যখন বান্ধবীকে নিয়ে মেতেছিল পরিকল্পিত বিকৃত সম্ভোগে সেই ঘরেই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের মৃত্যু হয়নি কী তখন? মৃত্যু কী শুধু শরীরের হয়?

আজ থেকে তিন বছর আগে এভাবেই শিরোনাম হয়েছিল সতের বছরের ঐশী। বাবা ছোট্ট একটি চাকরি করতো। যা বেতন তা দিয়ে বাড়ি ভাড়াও হয় না। অথচ মেয়ের হাতখরচ বাবার বেতনের প্রায় তিনগুণ। মেয়ে জানে তার বাবা কী করে এই অর্থ আয় করেন। মেয়ে জানে বাবা কীভাবে জন্মদিনে তাকে আইফোন কিনে দিলেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লেনদেন তো কতদিন তাদের বাসার ড্রয়িং রুমেই হয়েছে। জীবনের প্রথম ইয়াবা সেবন তো সেই সূত্র থেকেই। প্রথম ইয়াবা তো সে বাসাতেই পেয়েছিল।

অর্থ না থাকার দুঃখ ছিল ঐশীর মায়ের। বাবা ছিলেন অভিযুক্ত। বাবা ছুটেছেন অবৈধ অর্থের পেছনে। মা ব্যস্ত ছিলেন অর্থ বিত্তবৈভব, কেনাকাটা, আত্মীয় পরিজন নিয়ে। মায়ের গর্ব তার মেয়ে ইংরেজিতে কথা বলে। আধুনিক পোশাক পরে, আইফোন-ট্যাব-ল্যাপটপ ব্যবহার করে। তার মেয়ের বন্ধুরা কত ‘স্মার্ট’ তারা একসঙ্গে আড্ডা দেয়, খেতে যায়, বেড়াতে যায়। পার্টিতে যায়…। আগে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতো। তারপর সন্ধ্যার পর, তারপর গভীর রাত…। একদিন দেখা গেল রাতে বাড়িতে ফিরলো না মেয়ে। চিন্তায় পড়ে গেলেন বাবা-মা। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন, মেয়ে অবাধ্য, কথা শোনে না। কী যেন খায়…। মেয়ের সেই ‘স্মার্ট’ বন্ধুদের সন্দেহ হয়। কিন্তু ততদিনে সব চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

sadia-10
সাদিয়া নাসরিন

বাবা-মাকে খুন করার আগে সতের বছরের ঐশী একটা চিঠি লিখেছিল। সে নিজে এটাকে সুইসাইড নোট হিসেবে উল্লেখ করেছে। ঐশীর সেই চিঠি আমাদের বন্ধ চোখের অন্ধত্ব কতটুকু সারাবে জানিনা, তবু এখানে তুলে দিলাম যেন এই চিঠি পড়ে অন্তত নিজেদের একবার আয়নায় দেখি। সন্তানের হাতে জীবন দেয়ার পেছনে, কতটা আমাদের দায় আর কতটা নিয়তি সে হিসেবটা যেন এবার করি।

প্রিয়,

আমি জানি না এই চিঠি আমি কাকে লিখছি। তারপরও কাউকে না কাউকে কিছু একটা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত। আত্মহত্যার কারণ আমি কাউকে বলতে চাইছি না। একজনের দুঃখ সাধারণত আরেকজন কখনোই মন থেকে বুঝতে পারে না। আমার এই চিঠিটাকে সুইসাইডাল নোট বলা যেতে পারে। তুমি নিশ্চয় অবাক হচ্ছো, জীবনের শেষ কথাগুলো আমার আত্মীয়-স্বজন, বাবা-মাকে না জানিয়ে কোনো অপরিচিত কাউকে কেন জানাচ্ছি! তারা কোনোদিনও আমাকে বুঝতে পারেনি আমার অনেক খারাপ দিক আছে- সেই খারাপ দিকগুলো চালাকি করে বুঝে ফেলা ছাড়া ভালো দিকগুলো কখনোই তারা বোঝার চেষ্টা করেছে কি-না সন্দেহ! আমার এই চিঠিটি তাদের দেখাতে লজ্জা এবং ঘৃণা লাগে। কারও প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। আমি জানি, তারা আমাকে অনেক ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বা দোষ ধরার ইচ্ছা, রাগ, শক্তি কোনোটাই আমার এখন আর নেই। শুধু একটাই আফসোস থেকে গেল- জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিলো কোনোটাই পূরণ করতে পারলাম না। এ পৃথিবীর মানুষ সবাইকে বুকের মাঝে নিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম সবই কেমন যেন ধুয়ে-মুছে গেল, সব শেষ। আচ্ছা সব কিছু এমন হয়ে গেল কেন, বলোতো?

আমিতো মানুষকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম! পৃথিবীকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম! আমার স্বপ্ন আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো আমি কী মন দিয়ে চাইনি! শুধু মন দিয়ে চাওয়া এই স্বপ্নগুলো পূরণ করার জন্য কত কষ্টই না করলাম। মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে শারীরিক কষ্টটা হয়তো অন্যের দৃষ্টিতে এত বেশি হবে না। আমার জন্য তা অনেক ছিলো। আহ, ওহ, মানসিক কষ্টের কথা বলতে গিয়ে আমার হাত কাঁপছে। একটা সময় ছিলো, এমন কোনোদিন যেত না যে আমি কাঁদতাম না। জীবনের দুইটা বছর নষ্ট হয়ে গেল। দুইটা বছর একা একা কাটালাম। এ দুইটা বছর যে কিসের ভেতর দিয়ে গিয়েছি, আমি আর ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না।

মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এখন সবকিছুই সহজ মনে হচ্ছে। এক ধরনের স্বস্তি বোধ করছি। সবচেয় বেশি স্বস্তি বোধ করছি জীবন যুদ্ধ আর আমাকে করতে হবে না জীবনযুদ্ধে হেরে গেলাম এই কথাটা আগে শুধু বইতে পড়তাম। তখন অনুভব করতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া আসলে কী জিনিস। একটা মানুষের বুক কতটা ভেঙে গেলে এই ধরনের, এই সাধের জীবন, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে! তার বুক ভাঙা কষ্টের কি কোনো দাম নেই। আমি এমনকি খারাপ কাজ করেছিলাম যে, কোনো কিছুই সত্যি হতে দেখলাম না। মাঝখান দিয়ে জীবনে আরো যে যুদ্ধ করে যাব সেই উপায়টাও শেষ হয়ে গেল। ঈশ্বর বুঝি আসলেই পাষাণ

লেখার মতো আরো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু আর কিছুই লিখতে পারছি না। জ্বরের জন্য হাত কাঁপছে। শরীর জ্বলন্ত আগুনের মতো গরম। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। এখন যে কেউ একজন গায়ে হাত রাখবে এমন কেউ নাই। থেকেও যেন নাই। এই কথাটা সত্যি- মানুষ পৃথিবীতে আসে একা, চলেও যায় একা। হায়রে পৃথিবী! কত ভালোবাসার, কত সাধের! আমি ভাববো এক সময় পৃথিবী নামে আমার পরিচিত একটা ছেলে ছিলো!

ইতি

ঐশী/ডালিয়া

 

শেয়ার করুন: