মলি জেনান: বেশ কিছুদিন ধরে আমি টিভি খবর, সংবাদপত্র, মুখবই সবকিছুই এড়িয়ে চলছিলাম, ব্যক্তিগত জীবনে চরম সঙ্কটময় সময় পার করছি তাই কোন রকম দুঃসংবাদ আর নিতে পারছিলাম না; আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে সবরকম দুঃসংবাদ এখন খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু আমার দুর্বল মন কোন কিছুই আর গ্রহণ করতে পারছেনা। আপনারা ধরেই নিতে পারেন আমি মনোবৈকল্যে ভুগছি, কারণ এহেন সমাজে দিনাতিপাত করে যে দুঃসংবাদ সাদরে গ্রহণ করতে পারে না তার মানোবিদের শরণাপন্ন হওয়া অবশ্য জরুরি, হয়েও ছিলাম।
বেশ লম্বা বিরতি দিয়ে আমার/আমাদের নিজস্ব প্লাটফর্ম উইমেন চ্যাপ্টারে চোখ বুলিয়েছি, আশা ছিল বেঁচে থাকবার জন্য যতটুকু সাহস সঞ্চয় করা দরকার তার প্রয়োজনীয় রসদ এখানে পেয়ে যাবো। পুরো প্রচ্ছদ জুড়ে আকতার জাহানের স্বেচ্ছামৃত্যু আর সুইসাইডাল নোটের চুলচেরা বিশ্লেষণ! তবে বেঁচে থাকবার সাহসের প্রয়োজনীয় রসদ যে পাইনি তা নয়, পেয়েছি, ড. কাবেরী গায়েন ও বন্যা আহমেদের লেখায়। শুধু অহেতুক আহা উহু করে একটি স্বেচ্ছামৃত্যুকে অকারণে মহিমান্বিত না করে তাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত; হ্যাঁ অন্তত আকতার জাহানের ক্ষেত্রে।
ড. কাবেরী গায়েনের লেখায় তথাকথিত সংবেদনশীলতার যথেষ্ট অভাব থাকার যে অভিযোগ রয়েছে, তা থাকাই উচিত, কারণ এখন ঘোর দুঃসময়। স্নেহময়ী, করুণাময়ী, লক্ষ্মী, সর্বোপরি তথাকথিত ভালো মেয়ের সুভাষণের দাসত্ব থেকে এখনই মুক্তির সময়। পুরুষতন্ত্র তার নিজের প্রয়োজনে ভালো মেয়ের তকমা আমাদের পিঠের উপর সিন্দাবাদের ভূতের মত চাপিয়ে দিয়ে আমাদের জ্বরাগ্রস্ত করে রেখেছে, আর তাতেই হারিয়েছে আমাদের নিজস্বতা, বেঁচে থাকবার সাহস আর ব্যক্তিত্ববোধ।
আকতার জাহানের বন্ধু ও স্বজনদের ভাষ্য মতে, প্রচণ্ড শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে, যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আত্মহত্যা কিছুতেই তার প্রতিবাদ হতে পারে না, অন্তত উনি যে প্লাটফর্মে ছিলেন সেখান থেকে তো নয়-ই।
আমাদের কন্যারা যখন লাঞ্ছিত হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, খুন হচ্ছে, ইভটিজিং এর শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে, এই সময় আকতার জাহানদের বাতিঘর হয়ে উঠা উচিত ছিল, যার কাছ থেকে সবাই সাহস পাবে, একটু আলোর মুখ দেখবে, তা না হয়ে এই আত্নহত্যা আমাদের কী মেসেজ দিয়ে গেল!! এভাবে প্রতিবাদ হয় না।
যেখানে প্রতিনিয়ত তনু-আফসানারা নির্যাতিত ও খুন হয়েও লাশকাটা ঘরে গিয়ে পোস্টমর্টেমের নামে আত্মহত্যা করছে, সেখানে আকতার জাহান আপনার স্বেচ্ছামৃত্যু পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহকদের চপেটাঘাত করে না মোটেই। চপেটাঘাত করে যারা শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে একটু মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে চায় তাদের।
আপনার স্বেচ্ছামৃত্যুতে আপনার বন্ধু-স্বজন যারা আপনাকে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হতে দেখেও কাঁধে নির্ভরতার হাত রেখে পাশে না দাঁড়িয়ে মুখে কুলুপ এঁটে নিরাপদ দূরত্বে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল আপনার করুণ পরিণতির জন্য, তারা শুধু হা-পিত্যেশ করবার জন্য কুলুপ খোলার সুযোগ পেয়েছে, আর পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক স্বামী নামক পুরুষগুলো বগল বাজাবার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে, আর কিছুই নয়; আহা!
যদি এমনটি হতো দেরিতে হলেও আপনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন আর সেই দাঁড়ানোর মুহূর্ত হতেই কাউকে পাশে পাবেন না জেনেই যদি নিজেকে চারদিকে ছড়িয়ে দিতেন, যদি বাচঁবার প্রতিটা মুহূর্ত তুমুল আনন্দে বাঁচতেন, সমাজের/পরিবারের ভালো মেয়ের তকমাকে ছুঁড়ে ফেলে খারাপ হয়েই নিজের জন্য বাঁচতেন!! তবেই দেখতে পেতেন মহীরুহ হয়ে উঠা এ সমাজের নর্দমার কীটগুলো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আপনাকে নষ্ট মেয়ের তকমা লাগিয়ে থামাতে চাইতো, তারপরও যদি আপনি জীবনকে উদযাপন করে বাঁচতেন তাহলেই কীটগুলো নখদন্তহীন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়তো, ঘৃণার মুখোশে আসলে ওরা আপনাকে ঈর্ষাই করতো আপনার যাপিত জীবনের জন্য; আপনি বেচেঁ যেতেন, আপনার সন্তান আপনার ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে বেড়ে উঠতো, আমারা যারা অন্ধকারে একফোঁটা আলোক বিন্দু হাতড়ে ফিরি তারা একটা আলোক শিখা দেখতে পেতাম। আপনার আত্নহনন তাই আমাকে আরো হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত করে…।

যে দুঃসময়ে বাবা-মা’র সন্তানের পাশে থাকা উচিত সে সময়গুলোতেই আমাদের কন্যা সন্তানগুলো সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত থাকে। আকতার জাহানের মত পূর্ণবয়স্ক, সুশিক্ষিত, পায়ের নিচে শক্ত প্লাটফরম থাকা মানুষের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। চরম দুঃসময়েও তার পরিবারকে তিনি পাশে পাননি, অজুহাত ওই একটাই পারিবারিক/সামাজিক মানসম্মান! এ এক নির্লজ্জ রসিকতা! আমাদের সমাজে মেয়েগুলোর জন্মই হয় পারিবারিক মানসম্মান নামক সিন্দাবাদের ভুত কাঁধে নিয়ে। মেয়েগুলো বড় হতে থাকে আর মানসম্মান নামক বোঝাটাও বাড়তে থাকে। এই বোঝার ভারে মেয়েরা মাথা উঁচু করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেই ভুলে যায়। পারিবারিক চাপ, সামাজিক চাপ, ধর্মীয় চাপ, এতো সব চাপ ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে ক্লান্তিতে বিশ্রাম নেবার মত ঘর থাকে না মেয়েদের।
শুধু বাবার বাড়ি আর স্বামীর বাড়ির মানসম্মান বাঁচিয়ে কোনভাবে বেঁচে থাকাই তার নিয়তি! বাবা-মা শুধু মেয়েদের সহ্য করে যেতেই শেখান, প্রতিবাদ নয়।
প্রতিবাদ করতে গেলে আগল খুলতে হয়, শেকল ভাঙ্গতে হয় আর আগল খোলা, শেকল ভাঙ্গা মেয়েগুলো এ সমাজে অস্পৃশ্য কারণ ওতে যে পুরুষতন্ত্রের প্রভুত্ব ভাটা পড়ে যায়। আমারা যদি আমাদের কন্যাদের পারিবারিক/সামাজিক মানসম্মান রক্ষার দাসত্বথেকে মুক্তি দিতে না পারি ওদের যদি মাথা উচু করে স্বাধীনভাবে বাচাঁর পথে হাঁটতে শেখাতে না পারি, তবে আমাদের কন্যারাও একদিন পারিবারিক মান সম্মান রক্ষার অভিনয় করে ভালোমেয়ের ইমেজ ধরে রাখতে রাখতে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কাছেই আশ্রয় নেবে।
নিজের এই ঘরহীন জীবনে অন্যের ঘরের দাসী হয়ে বাঁচার চেয়ে সমস্ত সম্পর্কের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মৃত্যুর কাছেই মুক্তি খোঁজবে……। কিন্তু এ মোটেও কাম্য নয়। প্রতিদিন জীবন উদযাপন করে বাঁচো। ভালো মেয়ের সুভাষণ ছুঁড়ে ফেলে নিজের জন্য বাঁচো মেয়ে……..