শাশ্বতী বিপ্লব: আমার মৃত্যুর পর তোমরা তার চুলচেরা বিচার করো না। জানতে চেয়ো না আমি কেমন মানুষ ছিলাম, কেমন ছিলো আমার জীবন। খুঁজো না কেন আমি মরে গেলাম। জানাতে চাইলে আমিইতো জানাতে পারতাম সব। আমার ব্যক্তিগত জীবন আমি একান্তেই রাখতে চেয়েছি, তোমরা তাকে প্রকাশ্যে এনে কাঁটাছেড়া করো না।

তোমরা ভাববে এইতো জেনে গেলে সব, শুধুই তোমাদের মতো করে। একজনের জীবন জানা কি অতই সহজ বলো! তোমরা জানবে না, মৃত্যুর সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরে আমি কত আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি জিতে গিয়েছিলাম।
তোমরা হয়তো আমাকে দোষারোপ করবে। আমাকে ভীতু, পলায়নকারী আখ্যা দেবে। বলবে আমি হার মেনে নিয়েছি। আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে তোমাদের আশংকা হবে।
শোনো, আমি ভীতু নই, হারও মেনে নিইনি। মৃত্যু মানেই হেরে যাওয়া নয়। আর সাহসের অভাবের কথা বলছো? নিজেকে মেরে ফেলতে কতটা সাহস লাগে তোমরা জানো?
জিজ্ঞেস করো তাদের, জীবন্মৃতের মতো যারা বেঁচে থাকে। জিজ্ঞেস করো সেই মানুষটাকে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যে বাঁচতে চায়। জিজ্ঞেস করো নিঃস্ব, অসহায়, না খেতে পাওয়া, রাস্তার কুকুরের মতো বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে; অথবা দুর্ঘটনায় সকল স্বজন হারানো কোন মানুষকে, মৃত্যু কত কঠিন। সর্বস্ব হারিয়েও কীভাবে মানুষ বাঁচে। কেমন করে আঁকড়ে ধরে খড়কুঁটো।
প্রতিদিন মরতে চায় কত মানুষ, কিন্তু পেরে ওঠে না। ভীতুর মতো বেঁচে থাকে। মরা কি অতই সহজ!!
অমন বাঁচা আমি বাঁচতে চাইনি।নিয়ত যুদ্ধ করে বাঁচা ক্লান্তিকর। আমি চাইলে যুদ্ধটা বেঁচে থেকেও জিতে যেতে পারতাম।কিন্তুু আমার ইচ্ছে করেনি। আমি ভীতু নই, মরণে আমার ভয় করেনা। আমি মরে গিয়ে জিতে গেলাম। নিজেকে বাঁচিয়ে দিলাম আরো কিছু সময় ক্লান্তিকর যুদ্ধ থেকে।
যেকোন উপায়ে বেঁচে থাকতে হবে এমন দিব্যি আমাকে কেউ দেয়নি। দিলেও আমি সেটা মানিনা। মৃত্যু আমার কাছে কম ক্লান্তিকর ও সহজ মনে হয়। আমি সহজেরে ভালোবাসিলাম। মনে মনে বললাম, মরণরে তুঁহু মম শ্যামসমান।
আমি ক্ষমা করেছি সবাইকে। আমি ক্ষমা করেছি মানুষের হীনমন্যতাকে। ক্ষমা করেছি মানুষের স্বার্থপরতাকে। ক্ষমা করেছি মানুষের মনের অন্ধকারকে। যে অন্ধকার মানুষের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
শোন মাানুষ, আমি তোমাদের দোষ দেই না। যারা তোমাদের মনে এই অন্ধকার বুনে দিয়েছে, দোষতো তাদের। যারা তোমাকে শুধু পুরুষ বা নারী হিসেবে বড় করেছে, দোষ তাদের। যারা তোমাকে নিয়ন্ত্রণকামী অন্ধ হিসেবে বড় করেছে, দোষ তাদের। যারা তোমাকে সংসারের মালিক হওয়ার বা আজ্ঞাবহ হওয়ার দায়িত্ব ঠিক করে দিয়েছে, দোষ তাদের।
আমি তোমাদের ক্ষমা করেছি। ক্ষমা করতে শক্তি লাগে। আমি সেই শক্তি অর্জন করেছি।
তোমরা বলবে, আমি বোকা। আমিও তুমুলভাবে বাঁচতে পারতাম। জগতকে দেখিয়ে দিতে পারতাম আমার সক্ষমতা। কিন্তু তোমাদের সাথে বাঁচতে চাইনি আমি। চারদিকে বড্ড পুরুষ বা নারীতে ভরা। তুমুলভাবে বাঁচার জন্য মানুষ কোথায় পেতাম বলো?
গুছিয়ে লিখতে পারছি না। আমার চেতনা ঝাপসা হয়ে আসছে। শুধু মনে রেখো, আমার মতো আরো মরবে অনেকে। চিৎকার করে বাঁচা সবার পোষায় না। যদি পারো, বদলে ফেলো নিজেকে। মনের ভিতর আলো জ্বেলে নিও। মানুষকে ভালোবেসো মানুষের মতো করেই। অন্যকে বাঁচার জায়গা দিও। নিজেও বেঁচো মানুষ হয়ে।
তোমরা ভালো থেকো।