আমি কি ডরাই সখা ‘বেশ্যা’ গালিরে?

জেসমিন চৌধুরী: আপনি যখন আমাকে বেশ্যা বলে গালি দেন তখন আপনার উদ্দেশ্যটা কী থাকে? আপনি কি আসলেই ভাবেন আমি বেশ্যা? নাকি আমাকে দমানোর আর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে মরিয়া হয়ে উঠে আপনি আমাকে এই সম্মানে ভূষিত করেন? সম্মানই বটে! আমি বেশ্যা হই আর না হই, বেশ্যা কীভাবে একটা গালি হতে পারে, বলুন?

3আপনার জন্য আমার মায়া হয়, আমাকে ছোট করতে আপনার নিরলস এবং ব্যাকুল প্রচেষ্টার ব্যর্থতা দেখে। আপনি টের পেয়ে গেছেন আমি একজন শক্তিমান নারী, আপনি আমার শক্তিকে ভয় পান বলেই আমার দিকে ঢিল ছুঁড়েন, কিন্তু ঢিলটা যে আমার গায়েই লাগছে না আপনি তা টের পান না।

শুধু পুরুষ কেন, অনেক নারীও অন্য নারীকে অপদস্থ করার জন্য ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেন। একবার আমার এক বন্ধুর ছ্যাঁক খাওয়া মেয়েবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে অপদস্থ করা প্রয়োজন। তিনি আমার একটি ছবিসহ আমার পরিচিতজনদের কাছে মেসেজ পাঠালেন, ‘এই মহিলা বাংলাদেশে বেশ্যাবৃত্তি করতো, এখন ইউকে’তে এসে বিয়ে শাদি করেও বেশ্যাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে’।

গতকাল এ বিষয়ক একটি স্ট্যাটাসে দেখলাম একজন নারী মন্তব্য করেছেন, ‘বেশ্যাবৃত্তি যারা পেশা হিসেবে নিয়েছে তাদের জন্য বুকে জায়গা, কিন্তু যারা মুখে সতী, কাজে তাদের মতন, তাদের জন্য গালি হিসাবে এটা ছাড়া আর কিছু কি আছে?’

আশ্চর্য ব্যাপার তো! যদি এই পেশার নারীদের জন্য আপনার শ্রদ্ধাবোধ থেকে থাকে, আপনার বুকে তাদের জন্য জায়গা থাকে, তাহলে একজন বদ স্বভাবের নারীকে কেন আপনি ‘বেশ্যা’ গালি দেবেন? ফুল-পাখির জন্য আপনার বুকভরা ভালবাসা, কিন্তু কই আপনিতো কাউকে ‘ফুল’ বা ‘পাখি’ বলে গালি দেন না? আসলে যখনই আপনি বেশ্যা শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করেন, আপনি মূলতঃ বেশ্যাদেরকে অপমান করেন।

একজন নারী দুই কারণে বেশ্যা হতে পারে, পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে অথবা সচেতনভাবে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে। আমার মতে এই দু’টির কোনটাই লজ্জাজনক নয়। প্রতিটি পেশার মানুষই কোন না কোনভাবে তার দেহ ব্যবহার করে জীবিকা অর্জন করেন। বেশ্যাদের দেহ ব্যবহারের ধরনটি আপনার অপছন্দ হতে পারে, কিন্তু তাতে করে তার পেশা ছোট হয়ে যায় না।

অনেক সংগ্রাম আর টানাপোড়েনের পর আমার প্রাক্তন স্বামীকে তালাক দিতে সক্ষম হবার পর আমার ফেইসবুকের আদার বক্সে তার বন্ধু নামধারী এক (অ)ভদ্রলোক আমাকে একের পর এক মেসেজ পাঠাতেন। প্রতিটি মেসেজে তিনি আমাকে বেশ্যা বলে গালি দিতেন, এবং আমার চৌদ্দ বছরের মেয়েকেও আমি বেশ্যা বানিয়ে ফেলছি বলে মন্তব্য করতেন। তার ওসব মেসেজে আমার বিভিন্ন শারীরিক অঙ্গ নিয়ে নানান রকম কুৎসিত ইঙ্গিত থাকতো। একের পর এক ব্লক করার পরও তিনি নতুন আইডি থেকে আমাকে বেশ্যা গালি দিয়ে মেসেজ পাঠাতেন।

13336239_10154292980419850_751286349_n
জেসমিন চৌধুরী

একবার রাতের বেলা সিলেট শহরে গাড়ি চালানোর সময় এক বীরপুরুষ আমার গাড়ির সামনে তার মোটরবাইক আড়াআড়িভাবে থামিয়ে আমার খুলি উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন এই বলে, ‘ফতো ঘাটো ছিনালী করিছ না মাগী’।

কয়েকদিন আগে নারী অধিকারের উপর আমার একটি লেখায় এক পুরুষ মন্তব্য করেন, ‘ইনি নতুন তসলিমা নাসরিন, সিফিলিস এবং এইডসের ধারক এবং বাহক’।

এরকম আরও ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। আমার অন্যান্য নারীবাদী বন্ধুরাও প্রায়ই পুরুষদের দ্বারা এমন সম্বোধনে সম্বোধিত হয়ে থাকেন।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, একজন প্রতিবাদী নারীকে দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন আপনারা পুরুষশাসিত সমাজের শাড়ি এবং প্যান্টধারী পৃষ্ঠপোষকরা। এটা কীভাবে সম্ভব? হাজার বছরের ধারাবাহিকতা এবং কন্ডিশনিং উপেক্ষা করে মাথা তুলে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছে একজন নারী। সে পরিবর্তনের কথা বলছে, সমান অধিকারের কথা বলছে, অনেকক্ষেত্রে সে পুরুষকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।  

তার এমন ক্ষমতা আর সাহসকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় আপনার, আপনি ভাবেন নিশ্চয়ই সে কোন পুরুষের কাছ থেকে সাহস পাচ্ছে, নিশ্চয়ই তার গোপন সম্পর্ক রয়েছে কোন পুরুষের সাথে। তাই আপনি অবলীলায় তাকে বেশ্যা বলে গালি দেন, কারণ একটি মেয়ের নৈতিক চরিত্রকে আপনি এবং আপনার সমাজ আগেই ট্যাবু বানিয়ে রেখেছেন, এবং তার চলার পথকে কন্টকিত করতে তার চরিত্রের উপর আঘাত হানাই আপনার শেষ এবং মোক্ষম হাতিয়ার।

কিন্তু আপনি জানেন না, যে মেয়ে একা হাঁটার শক্তি অর্জন করেছে আপনার ছুঁড়ে দেয়া অপমানের ঢিল আর তার গায়ে লাগে না। তার কাছে বদলে গেছে  মান-অপমান ভাল-মন্দের সংজ্ঞা। বেশ্যাবৃত্তিকে অপমানজনক ভাবে না আর প্রগতিশীল নারী। তার সম্মানবোধ যোনির বেড়া ছাড়িয়ে, দেহের সীমানা পেরিয়ে অন্যত্র স্থান পেয়েছে। আপনার বানানো চরিত্রশুদ্ধির বর্ম, আপনার গড়ে তোলা নারীর যৌনতা সংক্রান্ত সব ট্যাবু পায়ের নীচে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েই সে একা হাঁটতে শুরু করেছে।

আপনি যখন লুকিয়ে বেশ্যাবাড়ি যান, টাকার বিনিময়ে নারীসঙ্গ উপভোগ করেন, নিজের কাম লিপ্সা চরিতার্থ হলেও বিষয়টা আপনার ঠিক মন:পুত হয় না কারণ নারীকে বিনামূল্যে অথবা পেটে ভাতে চুক্তিতে উপভোগ করতেই আপনি অভ্যস্ত। বিনিময়ে তার পায়ে আপনি পরিয়ে দেন সামাজিক স্বীকৃতির শৃংখল। সেই শৃংখল যখন কোন নারী ভাঙতে উদ্যত হয় আপনি তাকে বেশ্যা বলে গালি দেন। কিন্তু নারী আজ জেনে গেছে শৃংখল পায়ে বাঁচা জীবনের চেয়ে বেশ্যাবৃত্তি অনেক সম্মানের।

একজন নারী বেশ্যা হবার সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এটা তার অধিকার। একজন নারীকে জোর করে বেশ্যা বানানো হতে পারে, এটা তার দুর্ভাগ্য। কিন্তু রাতের আঁধারে বেশ্যাবাড়ি ঘুরে বেড়ানো পুরুষ কেন আবার তাকেই বেশ্যা বলে গালি দেবে? আর দিলেও তাতে নারীর কী আসে যায়?

শেয়ার করুন:

একজন নারী বেশ্যা হবার সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এটা তার অধিকার। একজন নারীকে জোর করে বেশ্যা বানানো হতে পারে, এটা তার দুর্ভাগ্য। কিন্তু রাতের আঁধারে বেশ্যাবাড়ি ঘুরে বেড়ানো পুরুষ কেন আবার তাকেই বেশ্যা বলে গালি দেবে? আর দিলেও তাতে নারীর কী আসে যায়?

একজন নারী দুই কারণে বেশ্যা হতে পারে, পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে অথবা সচেতনভাবে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে। …..প্রতিটি পেশার মানুষই কোন না কোনভাবে তার দেহ ব্যবহার করে জীবিকা অর্জন করেন

প্রনিধান যোগ্য