শামীম রুনা: বিশ্বজুড়ে মানবতা লুণ্ঠিত হচ্ছে। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু কম বেশি সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। নারীর ওপর সন্ত্রাস যেন তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশে নাৃরীর ওপর সন্ত্রাস দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটার কারণ হয়তো নারীর ওপর আগে-পরে হওয়া সন্ত্রাসগুলোর বিচার না হওয়ার জন্যই।
গত কয়েক মাসে তিনজন নারীর হত্যা আমাদের ভীষণরকম নাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের দারুণ সুরক্ষিত (!)জলপাই বনে তনুর মতো হিজাবী তরুণীর মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তনুকে হিজাবী উল্লেখ করছি, কারণ, হিজাবী মানে আমাদের অনেকের কাছে ধার্মিক, ভদ্র আর শোভন আচরণের বহি:প্রকাশ। তনু তাই ছিল। একলা চলাফেরা করা অনেক মেয়েকে দেখেছি, রাস্তা-ঘাটের অশ্লীল উক্তি আর অবাঞ্ছিত ধাক্কা থেকে রক্ষার উপায় হিসাবে বোরখা বা হিজাবকে রক্ষা কবচ হিসাবে পরিধান করতে।
তনু হিজাবী ছিল-তারপরও শেষ রক্ষা হলো না, নিরাপদ এলাকা ওকে কোনো নিরাপত্তা দিতে পারেনি। ওর হিজাব ওকে বাঁচাতে পারেনি, ওকেও নির্মমভাবে খুন হতে হলো, এই খুনের বিচার তো হলোই না, বরং নিত্যনতুন রঙচঙে আজব সব পিঠ বাঁচানো গল্প সকলের সামনে প্রশাসন উপস্থাপন করে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিল। তখনও দেশের কিছু মানুষ, যারা দেশের জন্য গর্ব করতে ভালবাসে, সেসব মানুষ নিজ নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে এই হত্যার প্রতিবাদ করেছে। বিচার দাবি করেছে। শেষ পর্যন্ত বিচার হয়েছে, তনুকে ভাল্লুকে মেরেছে!
খুন হলো এসপি বাবুল আকতারের স্ত্রী মিতু। খুনিরা তাঁকে সন্তানের সামনে, আরও অনেক মানুষের সামনে খুন করে পালিয়ে গেল। সাধারণ মানুষ আতংকিত হলেও পুলিশের নিজের ঘরের নিরাপত্তাহীনতা দেখে মনে মনে ভেবে নিল, এবার নিশ্চয় পুলিশ চুপ করে থাকবে না, খুনিরা ধরা পড়বে। মিতু যদিও নারী, কিন্তু সে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী, তাঁর প্রকৃত খুনিদের ধরা বা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা আশাবাদীই ছিলাম।
তবে এবারও বিচারের নামে প্রহসন, পুলিশের হাতে ধরা পড়া খুনিরা ক্রসফায়ার নামক সাজানো গেমে মরে যায়, খুনের কারণ আর গড ফাদার-মাদাররাও আড়ালে থেকে যায়। আমরা কী এক ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত হয়ে বাবুল আকতারের কাছে প্রত্যাশা করি, সে সিনেমার এ্যাংরি হিরোদের মতো গর্জে উঠুক, বিস্ফোরিত হোক। সেসব কিছুই হয় না, বরং জানা যায়, বাবুল আকতারের চাকরিচ্যুত হওয়ার খবর। হিসাব কেমন মেলে না, এমন হওয়ার কথা নয়, তারপরও এমন হচ্ছে; আমরাও বুঝে যাই, এই খুনেরও কোনো বিচার হবে না।
খুন হলো আফসানা। ওকেও নাকি ধর্ষণ-পরর্তীতে খুন করা হয়-পুলিশ আর হাসপাতাল প্রাথমিকভাবে তাই জানালেও পরবর্তীতে ময়নাতদন্ত শেষে রিপোর্ট বলছে, আফসানা আত্মহত্যা করেছে! হবে হয়তো।
আফসানা আত্মহত্যা করতে গিয়ে গলায় ফাঁস পরার পর ওর মরতে ইচ্ছে হয়নি, তাই সে একটা সিএনজি ভাড়া করে আল হেলাল মেডিক্যালে ছুটে গিয়েছিল-এটাই সত্য, আর সব মিথ্যা।
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে নারী হত্যার বিচার নামের প্রহসন হলো এগুলো। কে যে কাকে বাঁচাতে এসব নাটক সাজাচ্ছে তা আমাদের অজানা।
আগের কিছু নারী হত্যাকাণ্ড বা আত্মহত্যার কথা এখনও আমাদের বোধকে মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে যায়, কল্পনা চাকমা, ইয়াসমিন, কিংবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হওয়া সিমিকে আমরা ভুলে না গেলেও, প্রশাসন বা সরকার পক্ষ ভুলে যায় ঠিকই।
এবার মারা গেল ক্লাশ এইটের কিশোরী রিশা। রিশার মারা যাওয়ার কথা না, গিজগিজে ঢাকা শহরে যেখানে মানুষের গায়ে ধাক্কা না লাগিয়ে একপা ফেলা যায় না, সেখানে রিশাকে হাজার হাজার মানুষের সামনে খুনি ছুরি চালিয়ে চলে গেল। তখন রাস্তায় কি একজনও হৃদয়বান মানুষ ছিল না? যত দূর জানি, ওই সময় ওই এলাকায় ট্রাফিক পুলিশেরও থাকার কথা, তাদেরও কি দুর্ঘটনাটি চোখে পড়েনি? আহত বিপর্যস্ত একটি মেয়ে সাহায্যের আশায় ছুটে গেল স্কুলে, স্কুল কর্তৃপক্ষ পুলিশ কেইসের ঝামেলা বুঝে, বুঝে না রক্ত ক্ষরণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে, এমন অশিক্ষিত মূর্খ শিক্ষক দিয়ে হয়তো হাল চাষ হতে পারে, কিন্তু শিক্ষক হওয়ার ন্যুনতম জ্ঞান তাদের নাই, সে প্রমাণ তারা দিয়েছে।
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় এমন উটকো ঝামেলা কম বেশি সব মেয়েকে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পড়তে হয়। এইসব ঝামেলা থেকে আমরা কপাল জোরে বেঁচে আছি আর আমাদের এই বেঁচে থাকা গ্লানিকর করে তুলে রিশার মতো মেয়েরা অকালে মরে গিয়ে।

রিশার খুনি ধরা পড়েছে, হয়তো এই খুনির কোনো দলীয় পরিচয় নেই, তাই সে ধরা পড়েছে। শিল্পপতির কন্যা শাজনীনের খুনিও ধরা পড়েছিল, সে খুনিরও কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা অর্থবিত্ত ছিল না, তাই ধরা সহজ হয়েছিল। শাজনীন হত্যার কিছু পরের ঘটনা, মডেল নায়িকা তিন্নী খুনের খুনিকে ধরা সম্ভব হয়নি, যদিও সবাই জানত খুনি কে। খুনির অর্থ-বিত্ত আর রাজনৈতিক দাপট ছিল, তাই সে এখনও ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। প্রবল দাপটে সেই খুনি এখন কানাডার রাস্তায় চলাচল করে।
বাবা-মাকে খুনের দায়ে ঐশীর ফাঁসির রায় হয়েছে। বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রাখার পরও মনে হয় কোথাও ভুল আছে, একজন মানসিক বিকারগ্রস্থ তরুণীর(!)জন্য এমন রায় ঠিক হয়নি। ঐশীর ফাঁসির মাধ্যমে কোনো গোষ্ঠি নিজেদের আড়াল করতে চাইছে না তো?
নারী যখন ওড়ার জন্য প্রস্তুত, সে সময় নারীদের নিয়ে এই রকম প্রবঞ্চনা, প্রহসন নারীদের আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেয়। এইসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসাবে দেখলেও দেখা যাচ্ছে দুর্ঘটনার পরও নারী সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছে না। মৃত নারীরা যথাযথ বিচার পাচ্ছে না, সমাজে নারীর বেঁচে থাকার জন্য, স্বাধীন চলাফেরা করার জন্য নিরাপত্তা পাচ্ছে না।
নারীদের সঙ্গে বাফুফেও অবিচারটা করলো, অথচ ওদের উদার হওয়ার কথা ছিল, ওরা খেলার জগতের মানুষ! অপরাজেয় কিশোরী নারী ফুটবলারদের লোকাল বাসে করে বাড়ি ফেরত পাঠানোর কারণটি যে এখানে আর্থিক সংকট নয় বুঝা যায়। দেশের জন্য এই মেয়েরা যে সম্মানটুকু বয়ে এনেছে তার পরিবর্তে ওদেরও সামান্য সম্মান দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাটুকু বাফুফে বোধ করেনি। অভিভাবক ছাড়া লোকাল বাসে এই কিশোরী খেলোয়াড়দের শুনতে হয়েছে পুরুষদের করা নানান কটুক্তি, এই কটুক্তির সারমর্ম কিন্তু একটাই; নারী তুমি বাড়বে না। এগোবে না।