‘নারী অধিকার’ শব্দটিতে এতো ভয় কেন সবার?

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা: নারী অধিকারের বা সমতার প্রসঙ্গ এলেই এক ধরনের রেসিস্ট্যান্স আসে, “মানবাধিকার বললে চলছে না? নারী অধিকার নিয়েই কেন এতো কথা? পুরুষের কি অধিকার নেই? পুরুষ কি নির্যাতিত হয় না? নারীরা কি নারী নির্যাতন করে না?”

এই প্রশ্নগুলো তোলার আগে নিজেকে একটা প্রশ্ন করে দেখুন তো, নারী অধিকার নিশ্চিত হলে পুরুষের কিছু কম পড়বে কি? এমন তো নয় যে পুরুষের কাছ থেকে অধিকার কিছু ছিনিয়ে নিয়ে নারীকে দেওয়ার কথা হচ্ছে। তাছাড়া যেকোনো নারীর সাত খুন মাফ করার কথাও হচ্ছেনা। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারীর যা অধিকার সে তো তারই। তা সেটা নিশ্চিত হলে ভয় কিসের এতো? কিসের ভয়??

Gender-inequality-in-US-03মানবাধিকার প্রসঙ্গে আসি। এ সমাজ এখনো ‘নারী’ শব্দটা না বলা পর্যন্ত ‘মানুষ’ বলতে যেকোনো ক্ষেত্রে নারীকে কল্পনা করতে অপারগ। নেতা, পাইলট, ড্রাইভার, কৃষক, কর্মকর্তা/ অফিসার, জেলে, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ, আমলা, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, সভাপ্রধান (পতি!), কর্মী,গবেষক, ফটোগ্রাফার, অভিযাত্রী- আরো আরো অনেক শব্দের ছড়াছড়ি আমাদের চারপাশে; এই শব্দগুলোর সাথে নারী শব্দটা জুড়ে না দেওয়া পর্যন্ত কেউ এই অবস্থান গুলোতে সহসাই নারীকে ভাবেন না।

ভাবেন না কারণ, নারীকে এসব ক্ষেত্রে তারা দেখেছেনও কম। দেখেছেন কম কারণ এই অবস্থানগুলোতে নারীর যাওয়ার পথটাতে হাজার রকমের বাধা এবং ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং ওঁত পেতে আছে পদে পদে। এতো পরিচয়ের ভীড়ে হাতে গোনা মা, বোন, রাধুনী, সেবিকা, স্ত্রী’ পরিচয়েই যখন নারী ঘুরপাক খায়, তখন ‘মানুষ’ শব্দটা বললেও তৎক্ষণাৎ একজন পুরুষ এর ছবিই মনে উঁকি দিয়ে যায়! সমাজ, রাষ্ট্র ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যা কিছু সিদ্ধান্ত তখন সব ঐ ‘পুরুষ ছবিটি’ মাথায় নিয়েই ঘটে। নারী হয়ে পড়ে আরো অস্তিত্ববিহীন। পথের এই বাধাগুলিও বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত। এ হেন পরিস্থিতিতে ‘নারী’ শব্দটি সবকিছুতে মনে করিয়ে না দিয়ে আর উপায় থাকে না! তাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার নিয়ত সংগ্রাম ‘মানুষ’ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার।

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার এই লড়াই অবশ্যই পুরুষ বিরোধী নয়। কারণ অসম সমাজ ব্যবস্থার ভুক্তভোগী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই। সাদা চোখে দেখতে গেলে পুরুষ নিঃসন্দেহে বেশ কিছু সুবিধা পান, কিন্তু পুরুষমাত্রেই কি চান সেই সব সুবিধা? এই সুবিধার বিনিময়ে যেসব অসুবিধা তাদের কিনতে হয় তা-ও কি চান সব পুরুষ? তাদের জীবনেও কী দুর্বিসহ সব সমস্যার জন্ম দেয়না এই বৈষম্য? ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা আর দায়-দায়িত্বের মাপকাঠিতে মেপে বৈষম্যগুলোকে যদি আমরা ক্রমাগত অস্বীকার করে যেতে থাকি, একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকি- তাহলে তা দিনশেষে সবার জন্যই ক্ষতিকর নয় কি??

Zinatএটা স্পষ্ট থাকা জরুরী যে- নারী আন্দোলন ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা’র বিরুদ্ধে; ‘পুরুষ’ এর বিরুদ্ধে নয়। আন্দোলনের বিষয় গুলোকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এনে বিবেচনা করলে তাতে বিষয়টা ‘নারী বনাম’ পুরুষে এসে দাঁড়ায়, ‘সুবিধা প্রাপ্ত বনাম সুবিধা বঞ্চিত নারী’তে এসে দাঁড়ায়। মনোযোগ ঘুরে যায় অন্য দিকে। ফলে ইস্যুগুলোকে দুর্বল করে দিতে সুবিধা হয়। এর ফলাফল আমরা ভোগ করি ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক, এমন কি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। এবং এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই নারীরা, যারা এতো বেশী বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যে প্রতিবাদ করার বা সেই শিকল ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহস বা শক্তি অবশিষ্ট নেই।

কারণ এক্ষেত্রে তাদের হয়ে কাজ করা নারীরাও আক্রমণের শিকার হতে থাকেন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক আর ব্যক্তিগত দিক থেকে। এই মানুষ গুলো তাতে কখনো মনোবল হারিয়ে ফেলেন, কখনো অপরাধবোধে ভুগেন, কখনো নিজেরাই সেই শেকলে আরো পেঁচিয়ে যান; তার কাজের পরিধি বা ফলাফলে ভাটা পড়ে। তবে আশার কথা হলো কেউ কেউ দ্বিগুণ দৃঢ়তায় কাজে নামেন, এই সংখ্যাটা কম হলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে।

কারো প্রতি প্রত্যাশা আর অধিকার, দুটো জিনিস গুলিয়ে ফেলার একটা চর্চাও বাধ সাধে অনেক সময়। বোঝাটা জরুরী যে, নারী অধিকার মানে মা- বোন- মেয়ে-বউ কিংবা শাশুড়ীর অধিকার নয়। সম্পর্কের ভিত্তিতে কারো প্রতি কারো প্রত্যাশা, আবদার কিংবা দেনা-পাওনার হিসেব থাকতে পারে। অধিকার নয়। অধিকার সার্বজনীন। প্রতিটি মানুষ এক একটি আলাদা সত্তা। তার সাথে অন্যান্যের সামাজিক অনেক সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাতে প্রত্যাশা তৈরী হয়। সম্পর্কের হিসেব-নিকেশ তৈরী হয়। দায় তৈরী হয়। সম্পর্কের টানা পোড়েন, মান অভিমান তৈরী হয়। এসবই দ্বিপাক্ষিক ও সম্পর্কের গভীরতার উপর নির্ভরশীল, এবং তা কখনোই একটা মানুষকে আরেকজনের উপর কর্তৃত্বের কিংবা বাধ্যবাধকতা তৈরীর অধিকার দেয়না। এজন্যেই চিরায়ত ‘মায়ের অধিকার বনাম বউয়ের অধিকার’ ডিলেমার আসলে কোনো ভিত্তি নেই।

মানুষ হিসেবে মানুষের নিজস্ব অধিকার থাকে। অধিকার থাকে মৌলিক চাহিদা মেটানোর। অধিকার থাকে মত প্রকাশের। অধিকার থাকে সুস্থ পরিবেশের। স্বাধীন চলাচলের। নিজের পছন্দ কিংবা অপছন্দ অনুযায়ী নিজেকে তৈরী আর প্রকাশ করার। চুক্তিভিত্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে (যেমন বিবাহ) বিশেষ কিছু অধিকারের প্রসঙ্গ আসে বটে। কিন্তু তাও তৈরী হয়েছে সমাজ আর তথাকথিত ধর্মীয় অনুশাসনের তৈরী বৈষম্যের কারণে। এছাড়া সম্পর্কের ভিত্তিতে অধিকার থাকতে পারে – কিন্তু সেটা সম্পত্তির উপর, একটা মানুষের উপরে আরেকটা মানুষের নয়।

আবার ‘মা- বোনের’ প্রতি সম্মান দেখানোর যে চর্চা নারী অধিকার কিন্তু তার কথাও বলেনা। এই মন গলানো দরদী আচরণ নয়, মানুষ হিসেবে নারীর অবস্থান এবং প্রাপ্যের প্রতি বিশ্বাস ও সম্মান থাকার বিষয়টাই মুখ্য। নারীকে ভীরু-দুর্বল-নমনীয় ভেবে তাকে আগলে রাখা বা ‘রক্ষা’ করা ও মাতৃস্থানীয়া ভেবে তাকে ‘মাথায় তোলা’র প্রচেষ্টা নারীকে বরং আরেক দফা বাঁধে।

যাই হোক,নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও আন্দোলন অনন্তকালের জন্যে নয়। এর বিস্তৃতি সমতা না আসা পর্যন্ত। যেদিন ‘শুধুমাত্র নারী বলে’ নারীর প্রতি কোনো বৈষম্য থাকবেনা,সেদিন অবসান হবে সমতা প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামের। পূর্ণতা পাবে মানবতা। সুতরাং নারী অধিকার প্রসঙ্গ উঠলেই ভয়ে মুখ শুকনো করা কিংবা টিটকিরি দিয়ে আরাম পাওয়ার চর্চা থেকে বের হয়ে আসুন।

আশ্বস্ত হোন, নারী অধিকার “সবকিছু নারীদের অধিকারে” যাওয়ার কথা বলে না, “মানুষ হিসেবে নারীর ন্যায্য অর্থেই প্রাপ্য অধিকার” এর কথা বলে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.