জেসমিন চৌধুরী: হোমপেজে শুধু ‘এ স্টার’ আর ‘এ স্টারের’ ছড়াছড়ি দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে ভাবছিলাম, আজকাল কি ‘এ স্টার’ বা ‘এ’র নিচে কোন গ্রেড পায় না কেউ? বিষয়টা কি? তারপর টিউবলাইট জ্বললো মাথার ভেতরে, ‘বি’ আর ‘সি’ গ্রেডের রেজাল্টগুলো হয়তো বা শেয়ারড হচ্ছে না। আমি কাউকে আক্রমণ করতে চাই না, শুধু যারা আশানুরূপ রেজাল্ট করতে পারেনি তাদেরকে এবং তাদের মা বাবাকে আমার শিক্ষাজীবনের পাশ, ফেলের গল্পটা বলতে চাই।
দস্যি মেয়ে হিসেবে প্রাইমারি স্কুলে আমি প্রতি ক্লাসেই ফেল করতাম। আমার বাবা স্কুলের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে প্রতিবারই আমাকে উপরের ক্লাসে তুলে দিয়ে শিক্ষকরা হুমকি দিতেন, আবার ফেল করলে তোমার আব্বাকে বলে দেব। এরকম করতে করতে ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠার সময় সবাইকে তাক লাগিয়ে আমি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে তৃতীয় হয়ে গেলাম। এই প্রথম আমার রেজাল্টের খবর আব্বাকে জানানো হলো। সেসময় রিপোর্ট কার্ডের বালাই ছিল না, স্কুলের মাঠে ছাত্রদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী ফলাফল ঘোষণা করা হতো। বাসায় গিয়ে যখন পাশ ফেলের কথা বলতাম, কেউ তেমন একটা পাত্তা দিত না। বড় সুখের ছিল দিনগুলো।
এরপর আর কখনো দ্বিতীয় হইনি জীবনে। ক্লাস এইটে সিলেট শহরের বড় স্কুলে পাঠানো হলো আমাকে, সেখানে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আবার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলাম। গণ্ডগ্রামের মেয়ে শহরের স্কুলে এসে এমন কাণ্ড করতে পারে?
ক্লাস নাইনে উঠার পর স্বভাবতঃই আমাকে বিজ্ঞান বিভাগে দেয়া হলো। আমার ঘাড়ের রগ একটা নয়, কয়েকটাই সারাজীবন ধরে তেড়া, তাই আমার জন্য শিক্ষকদের আগবাড়িয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়াকে আমি মেনে নিতে পারলাম না। তারা বললেন আমার বিজ্ঞান বিভাগেই পড়াশুনা করা উচিৎ, কারণ ভাল ছাত্ররা তা’ই করে, এবং মানবিক বিভাগ থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া খুব কঠিন।
আমি বললাম, আমি মানবিক বিভাগেই পড়বো এবং ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে দেখিয়ে দেব সবাইকে। ঊনত্রিশ বছর আগের কথা হচ্ছে, কাজটা আসলেই সহজ ছিল না।
আমাদের বাড়ি ছিল স্কুল থেকে পাঁচ মাইল দূরে। প্রতিদিন এতো দূর থেকে স্কুলে আসা-যাওয়াতে অনেক সময় লাগতো। সংসারের সব কাজকর্ম তখন আমাকেই দেখতে হতো। বৃদ্ধ মা-বাবার দেখাশোনা, রান্না বাড়া সেরে পড়ার সময় পেতাম খুব কম, কিন্তু অল্প পড়েই সব বুঝতে পারতাম দেখে খুব একটা সমস্যা হতো না।
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে আমি আবার সবাইকে নতুন করে তাক লাগিয়ে দিলাম। যা ভাবছেন তা নয়, এবার মহাসমারোহে ফেল করলাম আমি। মহাসমারোহে বলছি কারণ আমার টোটাল নম্বর ছিল ফার্স্ট ডিভিশনের অনেক উপরে, লেটার মার্ক ছিল দু’টো, কিন্তু আমি ফেল করলাম কারণ অংকে পেয়েছি মাত্র আটাশ।
আব্বা ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেন, ‘আমাদের বংশে আজ পর্যন্ত কেউ এসএসসি ফেল করেনি, আমার মেয়ে একটা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে’।
আব্বা জানতেও পারলেন না তার এসব রসিকতা আমাকে কতোটা আঘাত করলো। বাসায় মেহমান এলে আমি লুকিয়ে থাকতাম কারণ আমার রেজাল্ট নিয়ে একটা আলোচনা হবেই, তারপর আব্বা আমাকে ডেকে বলবেন, ‘তোমার মার্কশিটটা এনে দেখাও’ যেন লোকে বুঝতে পারে আমি আসলে ফেল করার মতো ছাত্রী নই। ভীষণ অভিমানে আমি কাউকে বলতে পারলাম না অংক পরীক্ষার দিন প্রচণ্ড ব্যথা ছিল আমা পেটে-পিঠে। মাসিক ঋতুস্রাব চলছিল, কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলা লজ্জার বিষয় ছিল বলে সাহায্য চাইনি কারো কাছে।
কী কষ্ট! কী অপমান! কী একাকিত্ব! কাউকে বুঝাতে পারিনি। শুনেছিলাম কলাপাতা আকৃতির পাতা বাহার গাছের পাতা খুব বিষাক্ত হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে সেই পাতার এক গ্লাস রস বানিয়ে খেয়েছিলাম আমি। মরিনি বুঝতেই পারছেন, কিন্তু বাজে ধরনের পেট খারাপ হয়েছিল। দশ-বারোটা কামরাঙ্গা মরিচ চিবিয়ে খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলাম, এসব খবর কেউ জানে না।
এই ঘটনা থেকে একটা শিক্ষা পেয়েছিলাম আমি, ভীষণ ভীষণ কষ্টের সময় মানুষ খুব একা হয়ে যায়। শরীরের অসুখে সবাই ছুটে আসে, কিন্তু মনের ব্যাপারটা বুঝতে চায়না কেউ।
আপনারা অনেকে হয়তো বলবেন, বাংলাদেশে ভাল রেজাল্ট না করলে ভবিষ্যত অন্ধকার। আমি বলবো, এটা আমাদের নিজেদের মানসিকতার উপরেই নির্ভর করে, সাফল্য আর আলোকিত ভবিষ্যতের সংজ্ঞার উপরে নির্ভর করে। জোর করা সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন না। আমি জানি হতাশার অনুভূতি কেমন হয়, এবং কত সহজে এরকম সময়ে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া যায়। আমাদের সময়ে পাতাবাহার বা কামরাংগা মরিচের চেয়ে বেশি কিছু সংগ্রহ করা সহজ ছিল না, এখন সব কিছুই হাতের কাছে।
সন্তানকে জানতে দিন তার প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন নয়, বরং মানবিক অর্জনই আপনার জন্য বেশি জরুরি, সম্ভবতঃ তাতে করে প্রাতিষ্ঠানিক অর্জনের ক্ষেত্রেও লাভ বই ক্ষতি হবে না। আর পরীক্ষায় খারাপ করার পর সহানুভূতি না দেখিয়ে আগে থেকেই সন্তানের মধ্যে এই বিশ্বাস গড়ে তুলুন, ভাল করলে ভাল কিন্তু না করলেও ক্ষতি নেই।
এবার আইজিসিএসই পরীক্ষার আগের দিন আমার ইংরেজ বন্ধু কেন ফোর্ড পাওয়েল তার মেয়ের উদ্দেশ্যে যে স্ট্যাটাস লিখেছেন, সেটা শেয়ার করতে চাই আপনাদের সাথে। তিনি তার মেয়েকে বলেছেন, ফলাফল যা’ই হোক না কেন তিনি তাকে নিয়ে গর্বিত তার ব্যক্তিত্বের জন্য, তার ম্যাচুরিটির জন্য।
‘Big day for my little girl today. Don’t know if the results are going to be amazing or if something will have gone terribly wrong.
I do know that if it is the former we’ll love celebrating a well-deserved success but if the latter then know this Jessica – I couldn’t be more proud of you, your maturity and how you’ve handled all the shite which has happened over the last three years.
You’ve been amazing over the last year especially and owned your education. If there are problems, we’ll deal with them and move on. And if not, then the universe for once will have given you what you deserve.’
সার্থকতাহীন সাফল্যে কি লাভ!