কৃষ্ণের জন্ম এবং ধর্মের পুরুষতান্ত্রিকতা

হিন্দুধর্মের অবতার কৃষ্ণের জন্ম নিয়ে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়লাম। এতোদিন পর্যন্ত বিষয়টার গভীরে ঢুকে এমনভাবে ভাবতে না পারায় একধরনের গ্লানিও বোধ করলাম।

কৃষ্ণের জন্ম-নাটক এবং তাঁর জীবনের বিনিময়ে একটি মেয়ের জীবন মৃত্যুর মুখে ফেলে দেয়া, এসবই এই সমাজের পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক। রচয়িতা শুধুমাত্র পুরুষ বলে সব ধর্মেই পুরুষের জয়জয়কার। অথচ যে মেয়েটির জীবনের বিনিময়ে সেইরাতে ছেলেটিকে (কৃষ্ণ) বাঁচানো হয়েছিল, তাঁকে কোথাও ‘অসামান্যা’ বলে বর্ণনা করা হয়নি। যেন মেয়েদের জন্মই হয় দিয়ে যেতে, নিতে নয়। কৃষ্ণের প্রাণ বাঁচাতে আরেকজন পুরুষ শিশুকে বেছে নেয়া হয়নি। বলির যূপকাষ্ঠে মাথা দিতে বাছা হলো একটি মেয়েশিশুকেই। অবশ্য এটা নতুন কিছু তো নয়। এমনই হয়ে আসছে, হতেও থাকবে এমনই।

Lord-Krishna-তার চেয়ে চলুন স্ট্যাটাসটি পড়ি বরং।

“আজ রাত্রেই মেয়েটি জন্মায়। গোকুলে ও গোপনে। তার মা তখন প্রসব-পীড়ায় অচেতন। কিছুক্ষণ পর যমুনার ওপার থেকে একটি লোক আসে। নিজের সদ্যোজাত ছেলেটিকে গচ্ছিত রেখে চুপিচুপি মেয়েটিকে তুলে নেয়। মায়ের মুখটি ভাল করে দেখার আগেই জন্মের মতো পরিবার-হারা হয় সেই মেয়ে।

মেয়েটিকে পাচার করা হয় মথুরার এক ঘুপচি কারাগারে। ছেলেটির প্রাণ মূল্যবান। তার প্রক্সি হিসেবে মেয়েটিকে রেখে দেওয়া হয়। মথুরার রাজা ছেলেটিকে মারতে এসে মেয়েটিকে পায় ও তাকেই নিয়ে যায়। মেয়েটি দ্বিতীয় বার হাতবদল হয়।

রাজা যখন পাথরের দেওয়ালে আছাড় মারতে যাচ্ছে কয়েক-ঘণ্টা-আগে-জন্মানো পুঁচকে মেয়েটিকে, হাত পিছলে ছিটকে যায় সে। এবং দৈব শক্তির গুনে বলে যায়, ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে, আমি মায়া, মহামায়া’। এরপর কোনও এক অজানা ঘটনা-পরম্পরায় তার ঠাঁই হয় দুর্গম বিন্ধ্য পর্বতে। সেখানেই সে বড় হয়।

মেয়েটির মা-বাবার কাছে ছেলেটিও বড় হয়। একটা সময়ে সেই মা-বাবা সত্যিটা জানতে পারে। ছেলেটি মথুরায় আসল মা-বাবার কাছে ফেরৎ যায়। কিন্তু মেয়েটির মা-বাবা ভুলেও হারানো মেয়ের খোঁজ করে না। কী লাভ খুঁজে? হারিয়ে যাওয়া, চুরি-যাওয়া, বিক্রি-হয়ে-যাওয়া, পাচার-হয়ে-যাওয়া ছেলেদের ঘরে তোলা যায়। মেয়েদের যায় না।

ছেলেটির এখন দু-জোড়া মা-বাবা। তার জীবনে অনেক প্রেম আসে। অনেক স্ত্রী আসে। অনেক সন্তান আসে। আসে রাজত্ব। মেয়েটির? কেউ জানে না। তার এক-জোড়া মা-বাবা, একটি প্রেমিক, একটি স্বামী, একটি সন্তান, একটুও ভূমি জুটেছিল কিনা, কেউ খোঁজ রাখেনি। একটি ছেলে-বাচ্চাকে বাঁচাতে প্রক্সি হয়েছিল সে, এই তার একমাত্র পরিচয়”।

……ঠিকই তো, এতো ঘটা করে কৃষ্ণের জন্মতিথি পালন করা হয়, কিন্তু একইদিনে জন্ম নেয়া একটি মেয়ে, যার পরিচয় তিনি ‘যোগমায়া’ বা ‘মহামায়া’ এবং যাঁর শক্তি নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই, সেই তাঁর জন্মতিথির কথা উহ্যই থেকে যায়। অথচ সেই রাতে কৃষ্ণের বদলে মেয়েটিকে যদি ‘রিপ্লেস’ করা না হতো, তবে কৃষ্ণের পরিণতিও তার আগের সাতজন সহোদরের মতোনই হতো। স্রেফ মেরে ফেলা হতো নিজের ক্ষমতা নিষ্কণ্টক রাখতে। এবং করতো তার আপন মামাই, যিনি জেনেছিলেন, নিজের বোনের ছেলের হাতে তিনি বধ হবেন।  

কী আশ্চর্য পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম বটে!

 

শেয়ার করুন: