উইমেন চ্যাপ্টার: নির্বাসিত কবি ও লেখক তসলিমা নাসরিনের আজ জন্মদিন। আজ থেকে ৫৪ বছরে পা দিলেন তিনি। এই জন্মদিন নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়ায় হৈ-হুল্লোড় নেই, যেমনটি থাকে একজন পুরুষ কবি ও লেখকের বেলায়। এটা কি শুধুমাত্র তসলিমা নাসরিন নারী বলে? আগল ভাঙা মানুষ বলে? পান থেকে সংস্কারের চুন খসানো ব্যক্তি বলে? নাকি ধ্বজাধারী পুরুষগুলোর মুখোশ খুলে দিয়েছেন বলে?
নারীরা আজ তাঁর মতোন করে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন বলে? পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ কাঠামোতে এখনও এই একবিংশ শতকেও যখন প্রতি পলে পলে নারীকে ঘরের ভিতরে ঠেলে দেয়া হয়, মুখে লাগিয়ে দেয়া হয় সংস্কারের স্কচটেপ। সবাই তসলিমা নাসরিন হয় না, হতে পারে না। কিন্তু মনে মনে সব নারীই জীবনের কোনো না কোনো এক সময় স্বপ্ন দেখেন তাকে ঘিরে থাকা সব শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার। সেখানেই তসলিমা নাসরিনের সার্থকতা।
‘ও মেয়ে শোনো’ কবিতাটিতে তিনি যখন বলেন,
‘পিঠটা টান টান করে, মাথাটা উঁচু করে দাঁড়াবে,
তুমি কথা বলবে, অনর্গল বলবে, যা ইচ্ছে তাই বলবে,
জোরে বলবে,
চিৎকার করে বলবে,
এমন চিৎকার করবে যেন ওরা দুহাতে ওদের কান চেপে রাখে’।
এটা শোনার পর সত্যি সত্যিই শিরদাঁড়া শক্ত ও ঋজু হয়ে উঠে। তিনি যখন সমাজ কর্তৃক নারীদের বেশ্যা ডাকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারীদের প্রতি আহ্বান জানান,
‘তুমি কোমরে দুহাত রেখে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বলবে, হ্যাঁ আমি বেশ্যা।
ওদের পিলে চমকে উঠবে।
ওরা বিস্ফারিত চোখে তোমাকে দেখবে। ওরা পলকহীন তোমাকে
দেখবে। তুমি আরও কিছু বলো কি না শোনার জন্য কান পেতে থাকবে।
ওদের মধ্যে যারা পুরুষ তাদের বুক দুরু দুরু কাঁপবে,
ওদের মধ্যে যারা নারী তারা সবাই তোমার মত বেশ্যা হওয়ার স্বপ্ন দেখবে’।
তাই তসলিমা আজ কেবল একটি নামই নয়, তসলিমা একটি আন্দোলন, তসলিমা একটি বিদ্রোহ। শৃঙ্খল ভাঙার যে গান তিনি গেয়ে যাচ্ছেন আজ অব্দি, সত্যিকার অর্থে সেই শৃঙ্খল ভাঙতে না পারলেও নারীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিবাদী। তাঁর ৫৪তম জন্মদিনে তাই উইমেন চ্যাপ্টার এর পক্ষ থেকে একগুচ্ছ বিদ্রোহী শুভেচ্ছা।
আজকের দিনে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তসলিমা লিখেছেন, “আজ সকালটা অন্যদিনের মতোই কিন্তু আবার অন্যদিনের মতোও নয়। আজ যে কোনও দিন, জানি। কিন্তু আজ থেকে আমার বয়স ৫৪ বলবো। সংখ্যাটা অচেনা, বিদঘুটে। কিন্তু করার কিছু নেই। আমি না চাইলেও আজ আমি মৃত্যুর দিকে একটি বছর এগিয়ে গেলাম। জন্মদিনের উৎসব আমি করতে পছন্দ করি না। এটি আমার কাছে যে কোনও দিনের মতো দিন অথবা একটুখানি দুঃখের দিন। সারা বছর বয়স ভুলে থাকি। এই দিনটা এসে বয়সটা মনে করিয়ে দেয়”।
বন্ধু ফারহানা আনন্দময়ী লিখেছেন, বিপ্লব বিপুল-বিশাল এক অধ্যায়, বদল তো একদিনে হয় না, একজন একা দাঁড়িয়েও বদলাতে পারে না কিছু… তাই তসলিমা নাসরিনও পারেননি। একার পাশে সদলে থাকিনি সেদিন। লড়াই অসমাপ্ত রেখেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছে, তাঁকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। যেতে যেতে তিনি সত্য কিছু কথা স্পষ্টভাষায় বলে গেছেন, যে কথাগুলো বলার মতন সাহস তো আমাদের কোনদিন ছিলই না, এমন কী আমাদের কান শুনতেও অভ্যস্ত ছিল না। তাই দু’হাতে কান চেপে তাঁকে নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ করেছি।
বঙ্গদেশের শতকরা ৯৯ভাগ বাঙালি পুরুষেরা এবং পুরুষতন্ত্রের বাহক ও ধারক অধিকাংশ নারীরা শুধু তাঁর কল্লা চেয়ে হল্লাই ক’রে গেছি। শৃংখল-ভাঙা সেই নারীর আজ জন্মদিন। আনন্দে থাকুন, লেখায় থাকুন, প্রতিবাদে থাকুন প্রিয় তসলিমা নাসরিন।