শামীনা আখতার: ছোটবেলায় আমরা পড়তাম… “নবীজী যে পথে যাতায়াত করিতেন, এক বুড়ী রোজ সে পথে কাঁটা দিয়া রাখিত। নবীজী অনেক কষ্টে সেই কাঁটা সরাইয়া পথ চলিতেন। একদিন নবীজী দেখিলেন পথে কোন কাঁটা নাই। এদিক ওদিক তাকাইয়া কোথাও বুড়ীকে দেখিতে পাইলেন না, খোঁজ নিয়া জানিলেন বুড়ী অসুস্থ। নবীজী বুড়ীর সেবা করিয়া সুস্থ করিয়া তুলিলেন”………।

আমি যে পরিবার এবং পারিপার্শ্বিকতায় বড় হয়েছি, সেখানে ধর্ম শিক্ষা, ধর্ম পালন ছিল, কিন্তু ধর্মীয় উদ্ধত্য ছিল না, আর তাই নিজের ধর্ম নিয়ে অন্যদের উপর অহঙ্কার করার মানসিকতাও তৈরি হয়নি। কিন্তু গল্পের মাধ্যমে এই এতোটুকু শিক্ষা কেন যেন মনের মধ্যে এক ছোট্ট নদীর মত প্রবাহ তৈরি করতো, একধরনের শান্তি পেতাম। নিজের অজান্তেই নিজের মাথাটা উঁচু হয়ে যেত। মনে হতো, যে ধর্মীয় কমিউনিটির আমি সদস্য, সেই ধর্ম জানে কীভাবে সর্বোচ্চ মঙ্গল আনতে হয়………।
কিন্তু এখন কী হচ্ছে এসব! আমারই ধর্মের নামে কেউ এখন অন্যকে হত্যা করছে! কে নামাজ পড়লো কী পড়লো না, কে হিজাব পরলো কী পরলো না, বিশ্বাস করলো কী করলো না তাতেই তার মাথা নামিয়ে দেয়া হচ্ছে! তাও আবার অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমারই ধর্মের মানুষ! তাহলে কি আমি একদিন ভুলভাবে মাথা উঁচু করেছিলাম!
যারা এতো বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, মানুষ হত্যার মতো সিদ্ধান্ত, তারা নিশ্চয়ই আমার চাইতে ধর্ম সম্পর্কে অনেক বেশী জানেন; তাহলে আমার ধর্ম কি তাই বলে!
যদি তাই বলে, তাহলে এবার আমি এবং আমার মতো হাজার হাজার সাধারণ মানুষ যাদের কাছে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়, এবং যারা হত্যাকে কখনই সমর্থন করি না, এমনকি মহাপাপী মনে করলেও না; নিরস্ত্র মানুষকে অতর্কিতে হত্যার সমর্থনকে কল্পনাতেই আনি না, তারা এবার কোথায় যাবো! আমাদের মাথা কী উঁচু হবে নাকি নিচু!
আমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি ঠিক কার কাছে চাই আমি জানি না। কিন্তু যারা সাধারণত এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন তারা দুভাগে বিভক্ত (আমার মতে)। একদল নিশ্চুপ, তারা সাধারণত ধর্মের সাথে নুন্যতম বিরোধী যেকোনো কার্যক্রমের তীব্র বিরোধিতা করেন; এই যেমন নারীর সম্পত্তি বিষয়ক আইনের বিষয়ে আমরা তাদেরকে সোচ্চার হতে দেখলেও, এখানে তারা নিরব। আরেক দল যারা তীব্রভাবে বলার চেষ্টা করছেন, না হত্যাকারীরা বিপথগামী, পথভ্রষ্ট কিছু মানুষ, এরা ধর্মের অনুসারী নয়………
সমাধানহীন এই আলোচনা চলছেই, আর মাঝখান থেকে অব্যাহতভাবে চলছে অমানবিক হত্যাকাণ্ড! একটার পর একটা। এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডই আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে, অবশ করে দিচ্ছে ক্রমশ:। আপাত: সমাধানহীন এই জীবনে ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছি যেন।
এরপর আসি রাষ্ট্রের কাছে। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব প্রত্যেকটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা দান। আমার খুব প্রিয়জনও যদি আমার বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় করে তবে আমার পাশে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। এখানেই রাষ্ট্র সার্বভৌম। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা লঘিষ্ট নয়, রাষ্ট্র প্রত্যেকটি নাগরিকের।
কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে কি সব নাগরিকের হতে পেরেছে? নাকি কোনো ধর্মের আধিপত্যকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের মধ্যে মিশ্রিত করা হয়েছে? যারা এর সমর্থন করেছেন তারা ভালো করেই জানেন, রাষ্ট্রের কোনো দলিলে কোনো ধর্মের কথা লিখে রাষ্ট্রের সেই সকল মানুষকে ধর্মের অনুসারী বা ভালো বানানো যায় না, বরং আধিপত্যবাদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়।
তবে আমরা এভাবে দেখলেও রাজনীতি ব্যবসায়ীরা কিন্তু ভুল করেও এসব করেন না। বরং তারা ভালো করেই জানেন, রাজনৈতিক চালে কীভাবে ভোটের পাল্লা ভারি করতে হয়! তারা এও জানেন সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের চাপে সেই প্রত্যন্ত গ্রাম-বাংলায় পড়ে থাকা রেনুবালা, হরিদাসরা কোনদিনও মুখ খুলবে না। যদিও রাষ্ট্র তাদের কাছেও দায়বদ্ধ।
কিন্তু গল্প যদি সেখানেই শেষ হতো তাও না হয় হতো, কিন্তু তাতো হলো না! সেই মিশ্রিত আধিপত্যবাদ ছড়িয়ে পড়লো রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে!
এবার আসি আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে…গুলশানের হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর সেখানে ফুল দিতে যাওয়া ছোট্ট একটি মেয়ে টিভি ক্যমেরার সামনে বলেছে, “বিদেশিরা এখানে এসেছে কাজের জন্য, তাদেরকে হত্যা করা আমাদের মান সম্মানের বিষয়”। তার এই ছোট্ট কথা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে, আমরা অতিথিপরায়ণ জাতি, অতিথির কোনো ক্ষতি আমরা করি না; যথাসাধ্য সম্মান করার চেষ্টা করি।
আমার কর্মজীবন পুরোটাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাথে। প্রত্যন্ত গ্রামে দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেখেছি ঘরে খাবার নেই, কিন্তু শেষ সম্বল খাবারটুকু থেকেও আপ্যায়নের চেষ্টার কমতি নেই। কারণ আমি তার দরোজায় একজন অতিথি। কী আছে অথবা নেই তার সাথে এর সম্পর্ক নেই, এটি আমাদের সংস্কৃতি; যা বংশপরম্পরায় বয়ে চলে আমাদের রক্তে।
কিন্তু আমাদের সেই শেকড়ের সংস্কৃতি নিয়েও টান দিচ্ছে কারা? কোন স্বার্থে? আমরা কার কাছে জানতে চাইবো!
নবীজী এবং দুষ্ট বুড়ীর গল্প আমরা সবাই পড়েছি বইতে ছোটবেলায়। দুঃখজনক হলেও ইস্লামের আর অনেক গাল-গপ্পের মতো এটিও মিথ্যা।