রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা: মানিয়ে চলার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে জীবন যায় হাজার হাজার কনিকা, অবন্তিদের। মৃত্যুর বিচার চাওয়ার বিলাসিতাও কেউ করে না।

একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল মানেই পর হয়ে গেল। আর কতোদিন চলবে এই সিস্টেম? শ্বশুর বাড়িতে যতো কষ্টই হোক না কেন, মা-বাবারা সেই একই উপদেশ দেবে, একটু মানিয়ে চলো মা। বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর ঘরই আসল জায়গা- এই প্রবোধ নিয়ে আর কতো মেয়ে যে হারিয়ে যাবে অপমৃত্যুর অতল গহ্বরে, নিরবে, নিভৃতে।
কিছুদিন আগে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলের বউ, সে নিজেও ডাক্তার, মারা গেল। মৃত্যুর পর তার বাবা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মিডিয়াকে বলেছে, মেয়ে আমাকে বার বার বলেছে, ‘বাবা তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ আমি বার বার ওকে বলেছি, ‘মা, একটু মানিয়ে চলতে চেষ্টা কর’।
সেই মানিয়ে চলতে চলতেই অসম্ভব মেধাবী মেয়েটা সত্যিই মরে গেল। তার মৃত্যুর কোন কুল-কিনারা আজও হয়েছে? হবেও না। শুনেছি, সেই মৃত্যুর দফারফা হয়েছে টাকার বিনিময়ে।
তার মানে এটা তো বলাই যায়, মেয়েটার মৃত্যুর জন্য যতোটা না তার স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি দায়ী, তার থেকে কোন অংশে কম দায়ী নয় তার বাবা।
ছোটবেলার এক আপা, নাম কনিকা। অনেক সাধ করে বিয়ে করেছিল তাদের বাড়ির লজিং মাস্টারকে। বিয়ের পর হরেক রকম কাহিনী শুনতাম! কখনও শুনতাম খুব সুখে আছে। কখনও শুনতাম শারীরিক, মানসিক, সকল প্রকার নির্যাতন চলে তার উপর। অথচ বেড়াতে এলে দেখতাম, ঐ আপার মা-বাবা গদগদ মুখে কতো প্রকার রান্নাবান্না করে যে খাওয়াতো! ভাবটা এমন, যেন ঐ রকম সোনার টুকরা জামাই কোটিতেও একটা মেলে না।
তারপর ফুরুত করে আপাটা একদিন মরে গেল। যারা তার লাশ দেখলো, সবাই দেখলো, তার গলায় জখমের চিহ্ন। শুধু আপার মা-বাবা ও স্বামী বলল, হুপিং কাশিতে মারা গেছে। পরে যখন বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করা হলো, তখন উত্তর এলো, থানা-পুলিশ করে মেয়েকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ওর একটা ছেলে আছে, ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিয়েছি।
একদিন শুনলাম, আপার মা-বাবাই আহ্লাদ করে আবার জামাইকে বিয়ে দিয়ে মেয়ে ঘরে এনেছে।
অবন্তীর বর আমার খুব কাছের বন্ধু। আর অবন্তী স্কুলে আমার দুই ক্লাস নিচেই পড়তো। দু’জন ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিল। ওরা কেমন ছিল দেশের বাইরে থাকায় জানা সম্ভব হয়নি। মাঝে যোগাযোগও ছিল না। হঠাৎ দেখি আমার বন্ধুটা ফেসবুকে নক করেছে। তারপর কতো প্রকার স্মৃতিচারণ! কিন্তু ফেসবুকে কেন জানি ফ্যামিলি ফটো পোস্ট করে না। বিষয়টা নিয়ে খটকা লাগলে প্রশ্ন করি। এমন ভাবে কথা বলতো যেন দুনিয়ার সব মেয়ে ওর পৌরুষে আঘাত করেছে।
গত ২৫ তারিখে হঠাৎই দেখি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে, অবন্তী আর নেই। তরতাজা, নিরোগ একটা মেয়ে হঠাৎই এইভাবে কীভাবে চলে যায়? স্কুলের পেজের নিচে কমেন্ট থেকে জানতে পারলাম, অবন্তীকে মেরে ফেলা হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কতোভাবে চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না।
ফেসবুকে অল্প কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলো। ভাবলাম, অবন্তীর বিষয়টা নিয়ে আমি লড়াই করবো। যোগাযোগ করলাম ওর ভাই এর সাথে।
কাজ হলো না। আমরা ব্যক্তিগতভাবে হয়তো অনেক শিক্ষিত হয়েছি। কনিকা, অবন্তিদের মা-বাবা হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে আদৌ কি এগিয়েছি? আমাদের মানসিকতার কোন উন্নতি হয়েছে? সেই তো একই ক্যাসেট বাজছে, ওর দুইটা ছেলে আছে, তাদের ভবিষ্যতের জন্য এ বিষয়টা নিয়ে কথা না বলাই ভালো। আইন আদালত অনেক ঝামেলার বিষয়, কে করবে এতোসব ঝামেলা(?) ইত্যাদি ইত্যাদি, একই ধরনের কথা।
আমরা কবে বুঝবো? যা মেনে নেয়া যায় না, তার সাথে মানিয়ে চলা যায় না। আমরা কবে নিজেদের বোঝাতে শিখবো (?), বিয়ে দিয়ে দেয়া মানেই স্বত্ত্ব ত্যাগ করা নয়। কেউ যদি অন্যায়ের শিকার হয়ে মারা যায়, তার অন্তত: মৃত্যু পরবর্তী বিচারটা পাইয়ে দেয়া বিলাসিতা নয়, আমাদের দায়িত্ব। সে যতো ঝামেলারই হোক না কেন।
জুলাই ২৮, ২০১৬