আনন্দ মজুমদার: মনে পড়ছে না ঠিক কবে, তবে সম্ভবত ১৯৯৬ এর দিকে মহাশ্বেতা দেবী বাংলাদেশে এসেছিলেন। ভারত-বাংলাদেশের একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক লেনদেনের অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা-সূত্রে। ভারতে সাহিত্যিকদের শ্রেষ্ঠ সম্মান জ্ঞানপীঠ তিনি পান ১৯৯৬ সালে – অর্থাৎ সেই বছরই।
নবম বা দশম শ্রেণী থেকে তাঁকে চিনি, পড়ছি তাঁর বই – গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এসে তাকে রাজশাহীতে পাওয়া এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। আমাদের ক্যাম্পাসেই, আমাদের বাসাবাড়ির ঠিক পেছনে হাসান আজিজুল হকের বাড়িতে উঠেছেন। কী উৎসবের ব্যাপার!
সাঁওতাল পল্লী থেকে একজন এসে তাকে তাদের পরগনায় নিয়ে যাবে – এমন প্রত্যন্ত কোনাতেও তারা ঠিক তাঁকে চেনে।… ‘সে আগুন ছড়িয়ে গেল, সবখানে!’
হাসান চাচাদের বাড়ির সেই সময়ে বোধ করি সবচেয়ে পরিশ্রমী মানুষ, হাসান আজিজুল হকের কন্যা শবনম সুমন (আমাদের সুমন আপা) – সকাল থেকে সন্ধ্যে কতো না কাজ করছেন। সুমন আপা সেই বাড়ির কাজের ফাঁকেই বোধহয় একটু নম্র ইচ্ছে দেখিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে যাবার – অমনি তিনি বলে বসলেন, সুমন না গেলে আমিও যাব না। ব্যাস হয়ে গেল – বাড়ির কাজকম্ম ফেলে সুমন আপাকে প্রায় কোলে নিয়ে তারা বিরাট গাড়ি করে চললেন সাঁওতাল পল্লীতে। আমরা শুনে হাত চিবালাম, আর কী!
পরে সুমন আপা বললেন, মাসিকে ওখানে গিয়ে আমরা আর চিনতেই পারছি না। আমাদের এমন আপনজন, তখন যেন ওদেরই একজন। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, নাচ, গান, জলের ব্যবস্থা, সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করে জানা হয়ে গেল তাঁর। তারপর প্রায় সত্তর বছরের তরুণী নাচ করলেন তাদের সংগে!
আহা — সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ থেকে সেই শেষের দিকের মনোরম নাচের দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে শুনে!
ফিরেও তাঁর তেজময়তা। দেখলাম ইন্সুলিন ইঞ্জেকশন নিচ্ছেন, কথার ফাঁকে পায়ের গোড়ালি ঘুরিয়ে ব্যায়াম করে নিচ্ছেন।
বেশ মজার লোক এই সব লেখকেরা — মোটেও গুরুগম্ভীর না দেখা যায়! বললেন ৯৯ বছর অব্দি বাঁচবেন। কথাগুলি এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলছিলেন! হাসান চাচা জিজ্ঞাসা করলেন, সেঞ্চুরি করবেন না? উনি তাঁর উত্তরে বললেন, না ৯৯-ই ঠিক, সেঞ্চুরি করতে চাই না!
আহা! আর নয়টা রান বাকি থেকে গেল তাঁর!
আমি এদিকে ভাবছি, যিনি দু’ হাতে লেখেন আর সমাজের আনাচে কানাচে কাজ করে বেড়ান, তাঁর ডায়বেটিস তাঁকে একটুও দমাতে পারে না, কী আত্মশক্তি! বললেন, একটু হিসেব করে চললে, একশ বছর বাঁচা যায় । যেন বাতলে দিচ্ছেন খেলায় জিততে গেলে কী কৌশল জানতে হয়!
কথাবার্তা হচ্ছে, সকলে চলে গেছে। আমি কেন জানি যাব না বলেই থেকে গেছি। বাবাও।
হাসান চাচা আর মহাশ্বেতা দেবী স্নান করে এলেন। মলয় ভৌমিক (অনুশীলন নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) — মলয় কাকা এসেছেন, সংবাদের জন্য একটা সাক্ষাৎকার নেবেন। এমন সুযোগ কি হাত ছাড়া করা যায়? টেপ রেকর্ডারের জমানা – তাই বেশ ক্যাসেটবন্দী হল সব।
সাক্ষাৎকার হবার পর পরদিন শুনলাম, সর্বনাশ হয়েছে, দুই ঘন্টার সাক্ষাৎকারের অনেক কিছু বোঝা যায় না। এখন কী করণীয়। কাঁচা বয়েসের আবেগে গদগদ আমি স্বেচ্ছায় সঙ্গেসঙ্গে সেই টেপ শুনে লিখতে বসে গেলাম, আর কী ভাগ্য, কালিদাসের জিভে সরস্বতী (মহাশ্বেতা) ধরা পড়ার মতো ব্যাপারটা যেন অনেকটাই সহজ হয়ে গেল!
সেই সাক্ষাতকারে অনেক কথাই তো ভুলে গেছি, তবু মনে আছে যে উনি বলেছিলেন, একটা ভাষা খুব ভালো করে শিখলে অন্য ভাষা শিখতে অসুবধে হয় না। মনে পড়ে সে সূত্রে, ইংলিশে গ্রাজুয়েট অনেক প্রোথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক আছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম।
মহাশ্বেতা দেবীর সেইবারের সফরসঙ্গী ছিলেন সদ্যপ্রয়াত আমাদের সকলের শ্রদ্ধার মানুষ মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল। আশ্চর্য, কয়েক দিনের ব্যবধানে চলে গেলেন দু’জন। মহাশ্বেতাকে ছেড়ে কেউ তাঁর কথা বলতে গেছে, তো তিনি বলে উঠছেন, আমি শুধু সঙ্গে এসেছি, আমি কেউ না!
কী অমায়িক আর বিনয়ী মানুষ!
অনেকের মত আমিও এক সময় তাঁর বই পড়তে খুব ভালবাসতাম। জিম করবেটের অনুবাদ পড়া হয়নি — শিকারের বই আমি ভালবাসি না বলেই কি? তবে সত্যজিত রায় সম্পাদিত সেরা সন্দেশে তাঁর অনবদ্য গল্প পড়েছিলাম। এখনো পেলে পড়ি আবার
কিছুদিন পরে তাঁর হাজার চুরাশির মা’র হিন্দি ছবি (গোবিন্দ নিহালিনির পরিচালনায়) দেখে একটু হতাশ হয়েছিলাম – সেই আবেগ পাইনি কিনা। তবে সেটে লেখিকা ছিলেন বলে শুনেছিলাম।

আরও পরে আমার প্রিয় বন্ধু মঞ্জীর তাঁর কাছে যায় এবং তাঁর সংগঠনের হয়ে কাজ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, সেই বিবরণ ভালো করে শোনার ইচ্ছে থেকেই গেল। (মঞ্জীর কাজের মানুষ, নিজের ব্যবসা নিজে গড়েপিটে তৈরি করেছে ছোটো বয়েসে, এখন সাধারণ ছেলেমেয়েদের হস্তশিল্পের ওপর প্রতিষ্ঠিত তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘ফোক’।)
বীরসা মুণ্ডারা মরে না – ফিরে আসে, সেই আশা ও শিহরণ তিনি আমাদের ত্রুণ রক্তে মিশিয়ে দিয়েছিলেন ‘অরণ্যের অধিকার’-এ। বেশ কিছু ছো্টো গল্প ও উপন্যাসের বই সংগ্রহ করেছিলাম, কিন্তু বহুবার আবাস পরিবর্তনের ফেরে সেসব হারিয়ে গেছে কে কোথায়। প্রিয় মানুষের মতো, খুঁজে খুঁজে বের করা প্রিয় লেখকের প্রিয় বই।
তাঁর চলে যাওয়ায় আমার তেমন কান্না নেই – কারণ তিনি সঙ্গে থাকবেন। তরুণ বয়েসে হারিয়ে যাওয়া শক্তিশালী প্রিয় লেখক, আবার পড়ার টেবিলে ফিরে আসবেন। যাদের কেউ নেই, কিছু নেই, তাদের সম্বল হবেন। যারা সঙ্গে থাকতে চেয়েছিল স্বপ্নে ও সংগ্রামে, তাদের ফিরিয়ে দেবেন হয়ত দ্রুত হারিয়ে-যেতে-থাকা কোনো অরণ্যের অধিকার।
(লেখাটি মুক্তাঙ্গন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে, নিচে দেয়া হলো লিংকটা)
http://nirmanblog.com/anandamayee/10649
সম্পর্কিত লিংক: মহাপ্রয়াণে ‘হাজার চুরাশির মা’ খ্যাত মহাশ্বেতা দেবী