একজন যোদ্ধার ডায়েরি (২য় পর্ব)

tania morrshed
তানিয়া মোরশেদ

মুক্তিযুদ্ধ! ১৯৭১, এমনই একটি শব্দ বা সংখ্যা, যা আমাকে সব সময় থমকে দেয়, আন্দোলিত করে একই সাথে! মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় আমার বয়স ছিল চার-এরও কম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি আমার পরিবারের কোনো সদস্যকে হারাইনি।

এক সময় আমার বাবাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তিনি যুদ্ধে (প্রত্যক্ষ) যোগ দেননি! তিনি বলেছিলেন, “আমি তোমাকে ও তোমার মা’কে (আমার মা তখন আবার ভাইকে বহন করছেন তা আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় জানতাম না) কার কাছে রেখে যেতাম? আমি না ফিরলে এভাবে বড় হতে পারতে?” আমি কথা না বলেও তাঁকে বুঝিয়েছিলাম, আমি তাঁকে একজন মুক্তিযোদ্ধা (যুদ্ধক্ষেত্রে) হিসাবেই দেখতে চেয়েছিলাম! আমার সারাজীবনের দুঃখ কেন আমি আর ১০টি বছসর আগে জন্ম গ্রহণ করিনি! বীর মুক্তিযোদ্ধা লালু এবং তাঁর মত আরো ১২ বৎসর বয়সী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জানবার পর ভেবেছি কেন আট বৎসর আগেও জন্মালাম না! তাহলে অবশ্যই আমার মা/বাবা অন্য কেউ হতেন!

কথাটি লিখে থমকে গেলাম! অন্য বাবা/মা হলে কি আমার এই চেতনা থাকতো?! হয়ত, হয়ত নয়! মুক্তিযুদ্ধের একমাস একটি গ্রামে থাকবার পর রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে বাধ্য হই আমরা, যাবার আর কোনো জায়গা ছিল না। আমার বাবা দেশ ছাড়তে চাননি। তাঁর বন্ধু পরিবার নিয়ে সেই গ্রাম থেকে ভারতে চলে যান। পরবর্তি আটটি মাস কীভাবে কেটেছে তা অন্য জায়গায় বলবো হয়তো। ১৯৭১-এর স্মৃতি নিয়ে আমার মা কিছু লিখেছেন। পড়তে গিয়ে এক জায়গায় থমকে গেলাম। সেই সময় বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশ (যাঁরা ভারতে চলে যান তাঁদের একটি অংশ) দেশে ফিরবার পর তাঁদের সন্দেহ হয় যে, যাঁরা দেশে ছিলেন এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেননি তারা প্রায় সবাই বুঝি রাজাকার! আমি যতটুকু বুঝি তা হচ্ছে, অস্ত্র হাতে না নিয়েও বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন যুদ্ধ করেছেন সেই সময়। গ্রামের যেই মানুষটি অচেনা মানুষের জন্য তাঁর নিজের ঘর, খাবার দিয়েছেন তিনি কী যুদ্ধ করেননি!! মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন যাঁরা তাঁরা কী যুদ্ধ করেননি!! আমার মা’র লেখার সেই বক্তব্যের সাথে মিল খুঁজে পাই নুরজাহান বোসের লেখা “আগুনমুখার মেয়ে” বইটিতে! নূরজাহান বোস নিজে কিন্তু ভারত যাওয়া বুদ্ধিজীবী সমাজেরই একটি অংশ! তিনি আরো কাছ থেকে তাঁদের দেখেছেন। একজন (ভারত ফেরত) আমার মা’কে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন (কিছুদিন আগে, মা’র লেখা পড়বার পর) যে, তাঁদের উচিৎ ছিল দেশে ফিরে দেশে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সাথে কথা বলা/জানা কেমন/কিভাবে ছিলেন দেশে থেকে যাওয়া মানুষেরা। একজন দু’জন বুঝছেন, বাকিরা? আমি অবশ্য মাথা ঘামাই না কে কী ভাবলো তাতে, আমি কী তা আমার কাছে পরিষ্কার থাকাটাই বড় কথা।

হুমায়ূন আহমেদের “দেয়াল” লেখাটি নিয়ে অনেক কথা শুরু হয়েছে, সব জায়গায়। আমারও মাথা ব্যথা শুরু (সত্যি মাথা ধরেছিল, লিখতে বসে ধিরে ধীরে কমে আসছে)! “মেহেরজান” ছবিটি মুক্তি পাবার পরও একই অবস্থা হয়েছিল। গোলাম মুরশিদের লেখা “মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর” সম্পর্কে ব্লগে পড়বার পরও! বইটি এক দাদাকে বলে (তাঁকে আবারও ধন্যবাদ) জোগাড় হয়েছে। কিছু দূর পড়েছিও। যে কারণে পড়তে চেয়েছিলাম তা দেখা হয়ে গেছে! একজন বাংলা ভাষার অধ্যাপক (অন্য পরিচয় যদি নাও দেই) কীভাবে লেখেন, “কুমারী হিন্দু নারীরাই ছিলেন ধর্ষিত হওয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রার্থী।” কেউ কোনোদিন “ধর্ষণের” “প্রার্থী” হয়! ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া কোনো বাচ্চা লিখলে বুঝতাম অর্থ জানে না। তিরিশ লক্ষ শহীদ নিয়ে যা বলেছেন সেটাও কাম্য নয়। সংখ্যা নিয়ে তর্ক করতে পারেন কেউ চাইলে। আমি তাঁদের বলি, “তিরিশ লক্ষ কেন, তিনজনও নয়, একজনই বা কেন মারা যাবেন?! আর সেই একজন আপনি নিজে হলে বুঝতেন।” “একটি নির্দলীয় ইতিহাস” লিখতে গিয়ে উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, বই/জার্নাল থেকে তথ্য নিয়ে লিখলে হয়ত কিছু সত্যি কথা লেখা যায় কিন্তু লেখার মধ্যে আন্তরিকতা/দায়বদ্ধতা না থাকলে তা কালজয়ী হয় না।

আর একটি প্রসঙ্গ না এনেই পারছি না। মেহেরজান এর প্রচারণা, গোলাম মুরশিদের লেখার প্রকাশনা, এখন হুমায়ূন আহমেদের লেখার প্রচারণা, প্রতিটিতেই প্রথম আলোর ভূমিকা লক্ষণীয়! চ্যানেল-আই ও বাদ যায় না, “মেহেরজানে”র সাথে কীভাবে যুক্ত ছিল!

তানিয়া মোরশেদ: মে ১৫, ২০১২

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.