গুলতেকিন খান বাহুল্য কিছু বলেননি

দিলশানা পারুল: কবি গুলতেকিন খানের প্রাক্তন স্বামী বাংলাদেশের একজন ভীষণ জনপ্রিয় কথাশিল্পী ছিলেন। ইনফ্যাক্ট ব্যক্তিগতভাবে আমি সে লেখকের একনিষ্ঠ ভক্ত বৈকি, কৈশোর কেটেছে হুমায়ূন এর বইয়ে ডুব দিয়ে। কোনো সন্দেহ নাই, আমি ভদ্রলোকের বই পড়তে যারপরনাই পছন্দ করতাম, এমনকি এখনও করি।

তিনি খুব ভালো লেখক, তার মানে কি এই তিনি অতি উঁচুদরের মানুষ? অথবা তিনি খুব উত্তম চরিত্রের পুরুষ? বাঙালি একটা গুণ খুব ভালো, মরে যাওয়া মানুষের সমালোচনা করা আমাদের বাঙালী সভ্যতা পরিপন্থী।

Gul-Hum Collageকোথায় লেখা আছে, মানুষ মরে গেলে তার জীদ্দশায় যত অপকর্ম আছে তা লুকিয়ে ফেলতে হবে? ভালোমন্দ মিলিয়েই তো মানুষ। তিনি লেখক হিসেবে অতি জনপ্রিয় ছিলেন কোন সন্দেহ নাই, কারণ তার সার্টিফিকেট আমরা পাঠকরাই দিতে পারি। কিন্তু তিনি স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন সেই সাটিফিকেট তো একমাত্র তার বিবাহিতা স্ত্রী দিতে পারেন, লেখক-পাঠক কিংবা সাংবাদিকের পক্ষে সম্ভব না।

এখন কথা হতে পারে তার মৃত্যুর পর নতুন করে তার চরিত্রের পোস্টমোর্টেম করার দরকার কী? বা এইটা সভ্যতা পরিপন্থী কিনা? ওয়েল, পাঠক হিসেবে লেখকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানা হেঁচড়া করা অশোভন বৈকি! কিন্তু যে ব্যক্তি তাঁর সাথে ব্যক্তিগত জীবনযাপন করেছেন, তিনি যদি মনে করেন তার ব্যক্তিগত জীবনকে দেরিতে হলেও প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত, তার সম্পূর্ণ নৈতিক এবং আইনগত অধিকার অপরপক্ষের আছে বৈকি!

তবে হ্যাঁ, পুরুষশাসিত সমাজে একজন জনপ্রিয় পুরুষের ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, তাও আবার একজন নারী, সেই অধিকার সমাজ যে দিতে চাইবে না সেইটাই স্বাভাবিক। যদিও গুলতেকিনের সাক্ষাতকারটি পড়ে কোথাওই মনে হয়নি ঊনি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হুমায়ুনের উপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করছেন। বরং সাক্ষাতকারটি যথেষ্টই সরল, একধরনের আনন্দ দুঃখের শেয়ারিং সেখানে ছিল।

Gultekin 3অনেকে বলছেন, আগে কেন ভদ্রমহিলা বলেননি? অথবা এতো সব যন্ত্রণা ঊনি সহ্য করেছিলেন কেন? আমার মনে হয়, আগে তাঁর ইচ্ছা হয়নি বা বলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাই বলেননি। এখন ঊনাকে জিজ্ঞ্যেস করা হয়েছে, ঊনারও ইচ্ছে হয়েছে ঊনি বলেছেন। ওই সাংবাদিককে কেউ বলেছিল যে, এসব প্রশ্ন করা যাবে না?

দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর আমি জানি না, তবে আমার মায়ের জীবন থেকে ধারণা করতে পারি। গুলতেকিন একজন মা। চার সন্তানের জননী এই সমাজে চাইলেই স্বামীর ঘর ছাড়তে পারেন না, সেখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। প্রতিবাদ-বিপ্লব পথে যত সহজ, ঘরে ততখানিই কঠিন। পথে প্রতিবাদ করে ঘরে ফেরার জায়গা থাকে, কিন্তু ঘরে প্রতিবাদ করে পথে নামার সাহস সবার নাই থাকতে পারে। তারপরও চার চারটি সন্তানকে সাথে নিয়ে একা একজন ভদ্রমহিলা কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। কী কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চারটি সন্তানকে একা বড় করলেন। মা হিসেবে, নারী হিসেবে কেন তিনি স্যালুট পাবেন না? কারণ তিনি একা নারী? নাকি তার স্বামী বিখ্যাত এবং তিনি অখ্যাত, এই কারণে?

বটবৃক্ষের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে গুলতেকিন আস্তে আস্তে চারা গাছ থেকে মহিরুহে পরিণত হয়েছেন। কজন নারী পারে সেটা?   

তবে গুলতেকিন তার স্বামীকে নিয়ে যা বলেছেন সেগুলা যদি সত্য-মিথ্যার মাপকাঠিতে বিচার করতে চান তবে কিছু কথা আছে বৈকি। একজন পুরুষ বিছানায় কেমন, সেটা কেবলমাত্র বেড রুমে যিনি তার সাথে দিন এবং রাত যাপন করেন তিনিই জানেন। কিন্তু লেখকদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটুখানি ভিন্ন। কারণ লেখকের লেখনিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তার মনন জগৎ এবং চিন্তা ভাবনার ছাপ পড়ে। বলতে পারেন, লেখক চান বা না চান তার লেখনি তার মনন জগতের আয়না হিসেবে কাজ করে। কাজেই লেখনির শৈল্পিক অংশটুকু বাদ দিয়ে যদি যুক্তির অংশটুকু ধরতে পারেন তাহলেই লেখক এর চিন্তা পদ্ধতি, সমাজ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক তার ভাবনা, আপনি ধরে ফেলতে পারবেন।

হুমায়ূন আহমেদ এর বেশির ভাগ উপন্যাসের একটি বড় অংশ জুড়ে নারী। কোন সন্দেহ নাই নারীর প্রতি তার অসীম ভালোবাসা ছিল। এবং অবশ্যই তিনি নারীকে ভালোবাসতেন।

সরল প্রশ্ন,  শ্রদ্ধা কি করতেন? আমি যদি বলি ঊনি নারীকে নয়, নারী শরীরকে ভালোবাসতেন? ঊনার প্রতিটা নারী চরিত্রের নাকের গঠন থেকে, চোখের চাহনি হয়ে শরীরের গঠন সমস্ত পাঠকের জানা। হিমুর রূপা কিংবা পরী চরিত্র, প্রতিটি নারী চরিত্রই তার উপন্যাসে সৌন্দর্য নিয়ে যতখানি হাজির হয়, বুদ্ধিমত্তা বা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কি ততখানি হাজির থাকে?

তাঁর উপমাগুলো মায়াবতী, ধারালো সুন্দরী, মা মা ভাব, স্নেহাদ্র চাহনী এর বাইরে কি যায় ? নারী চরিত্রটির বুদ্ধিমত্তা থাকলেও তা কবেলই সাংসারিক বুদ্ধিমত্তা। এক “কোথাও কেউ নেই” এর মুনা চরিত্র ছাড়া সংগ্রামী, প্রতিবাদী অথবা নিজের পায়ের তলে মাটি নিয়ে দাঁড়ানো একটা নারী চরিত্র তাঁর উপন্যাসে দেখান তো? অবশ্যই এর বিপক্ষে হুমায়ূন এর ভক্ত পাঠক হিসেবে আমিই যুক্তি দেখাবো যে, সমাজে ঊনি যেমন দেখেছেন, তেমনই তো লিখবেন!

আমিও তো তাই বলি, গুলতেকিনও ঠিক তাই-ই বলেছেন, এর বাইরে কিছু না। ঊনি জনপ্রিয় লেখক ছিলেন তো এই কারণেই, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের মনন জগতের কাঠামো ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পেরেছেন, কারণ তিনি এই সমাজেরই একজন পুরুষ তো! এতে ব্যাক্তির দোষের কিছু নাই, তেমনি এই সত্য অস্বীকার করারও কিছু নাই।

তাহলে এই সত্য প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে গুলতেকিনের দোষ হলো কোথায়? হুমায়ূন যেমন এই সমাজের নারী চরিত্র দিয়ে তার উপন্যাসের নারী চরিত্র নির্মাণ করেছেন, গুলতেকিনও তেমনি তার সংসারে এই পুরুষটিকে যেমন দেখেছেন তেমনই বলেছেন।                           

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.