পুরুষকেই কেন এটিএম মেশিন হতে হবে?

বিথী হক: ঠিক কতোটা শিক্ষিত হলে একজন মানুষের মানসিকতা উন্নত হয়? ঠিক কতোটা শিক্ষিত হলে একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়? ঠিক কতোটা শিক্ষিত হলে একজন নারী নিজেকে সবার আগে মানুষ ভাবতে পারে? আমরা যারা পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করে ধুয়ে দেই, এই আমরাই মাথা নিচু করে আমাদের থেকেই শুনি, “যাকে বিয়ে করবো তার মাইনে অবশ্যই আমার থেকে বেশি হতে হবে (!)

Bithy 2সুপ্রিয় নারীকূল, আপনি “যাকে” বিয়ে করবেন তার মাইনে আপনার থেকে বেশি হতে হবে কোন যুক্তিতে? যাতে আপনি আপনার স্বামীকে নিয়ে হীনমন্যতায় না ভোগেন? যাতে আপনার স্বামীর আয় বেশি বলে লোক-সমাজে গপ্পো দিতে পারেন? আচ্ছা একবারও কি ভেবেছেন, আপনার স্বামীর তুলনায় আপনার উপার্জন কম হলে আপনার তৃপ্তি আসে কেন?

আসে কারণ, আপনি আপনাকে আপনার স্বামীর চেয়ে নিচু শ্রেণির মানুষ মনে করেন। আপনি অবশ্য আপনাকে মানুষ নয়, স্ত্রীলোক মনে করেন। আপনার স্বামী যা পারে, আপনি তা পারেন না, এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। আপনার স্বামী যেহেতু পুরুষাঙ্গের অধিকারী, সুতরাং আপনার যাবতীয় সকল কিছুর দায়িত্ব তার নিতে হবে এটা স্বপ্ন দেখেন।

আচ্ছা আপনার কি একবারও মনে হয় না, কেন আপনি সবদিক থেকে আপনার স্বামীর তুলনায় কম হলে সমাজ আপনাকে সমাদরে গ্রহণ করে, আর আপনার স্বামীকে মাথা নিচু করিয়ে রাখে? লজ্জা লাগে না ভাবতে, নিজেকে ছোট করলে এতো আনন্দ আসে কেন? আর কেনই বা আপনি আপনার স্বামীর চেয়ে ভাল কিছু করেন, এটা স্বামী বেচারাও মেনে নিতে পারেন না? কেন আপনি ভাল কিছু করলে তিনি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যান? কেন আপনি আপনার স্বামীর চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠা পেলে সমাজ আপনার স্বামীর বেঁচে থাকা কঠিন করে তোলে?

মানেটা তো পরিষ্কার যে আপনি নিজেই সর্বস্বীকৃত নিচু শ্রেণির অপারগ জীব, যে রান্না-বান্না আর বাচ্চা পালন ছাড়া তামাম দুনিয়ার আর কিচ্ছুটি জানেন না এবং জানার জন্য উৎসাহ বোধও করেন না।

আপনার যুক্তি বড় অকাট্য হে! সে যদি আপনাকে সেক্স অবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে তো আপনারও তাকে এটিএম মেশিন ভাবতে দোষ নেই। তথাস্তু! কী বলতে চান, তার এটিএম কার্ড যেহেতু আপনার হাতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাই আপনাকে তার সেক্স অবজেক্ট বানানোর অধিকার আছে? আপনার সেখানে বাধা দেয়ার কিছু নেই?

সেক্স তো ধর্ষণ নয়, সম্মতি। তাহলে একজন আপনাকে সেক্স অবজেক্ট বানালো, আর আপনি বনে গেলেন।

আমার প্রশ্ন, আপনি যার কাছে নিজেকে সেক্স অবজেক্টের বেশিকিছু ভাবতে পারেন না, তাকে বিয়েই বা কেন করবেন? নিজের সম্মানের চেয়েও বিয়ে করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেন? শুধুমাত্র এটিএম কার্ডের জন্য? তার অন্য কোনকিছু আপনাকে টানে না!

মানে আপনার সম্মতি ছাড়াই দিনের পর দিন ব্যবহৃত হবার জন্য নিজেকে সাজিয়ে-গুছিয়ে একজনের কাছে তুলে দিচ্ছেন? আপনি নাকি শিক্ষিত, অনেক পড়াশোনা জানেন; তো ব্যক্তিত্ব বলে যে একটা শব্দ আছে বাংলায়, সেটা জানেন তো? নাকি সেসবে কোন আগ্রহ নেই? টাকা উপার্জনের যোগ্যতা যেহেতু আপনার নাই সেহেতু যেকোনোভাবে টাকা আসলেই বা কী, আর কিছু ভাবতে হচ্ছে না, এমনটাই ভাবেন!

এসব না ভেবে নিজেকে একটু সম্মান কি করা যায় না? সঙ্গীটাকে পুরুষ মানুষের জায়গায় না বসিয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে ফেলা যায় না?

আপনার মতো আপনার স্বামীরও একটু চাকরি ছেড়ে বাসায় কাটাতে ইচ্ছে কি করে না?

আমি ঘরের কাজকে ছোট করছি না, কিন্তু ঘরে থেকে কাজ করার ইচ্ছে তার হলে দোষ কোথায়? পুরুষ হয়ে জন্মেছে বলে তার রোজগারের বিষয়টা চন্দ্র, সূর্যের মতো ধ্রুব না বানিয়ে আপনার মতো করে ভাবতে দিতে পারেন না? আপনি যদি তার চেয়ে কম উপার্জন করে স্বস্তি পান তো তারও আপনার চেয়ে কম উপার্জন বলে স্বস্তি হবে এই পরিস্থিতি তৈরি করা দরকার। কেন সবকিছু এতো আরোপিত হতেই হবে?

সেও আপনার মতোই হাত,পা,নাক,কানসহ পঞ্চনেন্দ্রিয় বিশিষ্ট মানুষ। শারীরিক কিছু ভিন্নতা আছে বলে নিজেকে নিকৃষ্ট জীবে রুপান্তরিত না করে নিজেকে সম্মান করতে শিখুন। যে নিজেকে সম্মান করে, সে প্রত্যেককে সম্মান করতে পারে।

বিশ্বাস করেন আর না করেন, আপনার পশ্চাৎপদতার কারণ পুরোটা আপনি না হলেও অধিকাংশেই আপনি। ডিমকে বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে ভাঙ্গতে বাধ্য করলে ডিম থেকে জীবিত বাচ্চা ফুটে বের হয় না। কিন্তু ভেতর থেকে বাচ্চা ফুটে বের হতে চাইলে নিজেকেই ফুটে বের হতে হয়। সুতরাং আপনি নিজেই মাথা তুলে না দাঁড়ালে আপনার মাথা আরেকজন টেনে তুলে দাঁড় করাবে না। নিজের সম্মানের জন্য অন্যের সাথে হাউকাউ করার আগে তাই একটু নিজের দিকটা ভেবে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.