আমাদের চ্যাঁচামেচি চলছে, চলবেই

জেসমিন চৌধুরী: নিজের লেখা সম্পর্কে নানান মন্তব্য পড়তে গিয়ে মাঝে মধ্যে নিজেকেই প্রশ্ন করি, লিখি কেন? কী ঘোড়ার ডিম মেলে এই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে, ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখা ছাড়া?

সেই ছোটবেলা থেকেই কোন কিছু মনে দাগ কাটলে আঙ্গুল নিশপিশ করতো লেখবার জন্য স্কুলের খাতাগুলো্তে অংক আর বিজ্ঞানের চেয়ে ফুল পাতা বৃষ্টির কথাই বেশি লেখা থাকত দেখে আব্বা নিয়মিত খাতা চেক করতেন, পাতার অপচয় দেখলে নতুন খাতা কিনে দেয়া হতো না মায়ের লুকিয়ে কিনে দেয়া খাতাগুলোতেও সেই বনের মোষই তাড়াতাম এখন খাতার অভাবের স্থান দখল করেছে সময়ের অভাব, কিন্তু স্বভাব পাল্টায়নি একটুও কাজেই মোষ তাড়ানো চলছে, আর সেইসাথে বেড়ে চলেছে মোষের উপদ্রবও

Jesmine Chow 2
জেসমিন চৌধুরী

আমি সাহিত্য চর্চ্চা করিনা, কাব্য আমার আসে না সাধারণত নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সার্বজনীন কোন সমস্যার কথা তুলে ধরবার চেষ্টা করি, কারণ যে সমস্যাগুলো বারবার আমার নিজের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়, সমাজের একজন মানুষ হিসেবে সেই সমস্যাগুলোর দায় থেকে আমি নিজেও মুক্ত নই, এবং সেই দায়বদ্ধতার অবস্থান থেকেই আসলে লিখি

একটা লেখা লিখে ফেলার পর পেছন ফিরে তাকানোর সময় বা ইচ্ছা কোনটাই থাকে না, কিন্তু  লেখাগুলো সম্পর্কে অন্যদের মন্তব্য পড়ে কখনো কখনো মনে হয় কিছু একটা বলার বাকী থেকে গেছে, আরো সুন্দর বা স্পষ্ট করে বলা যেত, কিন্তু ধনুক থেকে ছুটে যাওয়ার তীরকে তো আর ফিরিয়ে আনা যায় না

মেয়েদের আত্মপরিচয় বিষয়ক আমার ‘আমি কি কেবলই ভাবী?’ লেখাটা পড়ে যারা আমাকে এবিষয়ে আরো বিশদ কিছু লিখতে অনুরোধ করেছেন, তাদের নিজেদের বক্তব্য এতোই প্রাঞ্জল এবং বিষয়োপযোগী ছিল যে আমার মনে হয়েছে তারাই এ ব্যাপারে অনেক ভাল লিখতে পারতেন সেইসব চমৎকার মন্তব্যের কিছু কিছু তুলে ধরতে চাই নাম উল্লেখ না করেই, যেহেতু এ বিষয়ে মন্তব্যকারিদের সম্মতি নেয়া হয়নি

একজন বলেছেন, ‘তাও তো আপনাকে জেসমিন ভাবী বলে, তাতে নাম আছে এর চেয়ে কঠিন অবস্থা আছে যেখানে ভাবীর নামটাই উধাও যেমন বাশার ভাই’র বউ ‘বাশার ভাবী’ কিংবা ওয়ার্ল্ডব্যাংকে চাকরি-করা ভাইয়ের বউ… ‘ওয়ার্ল্ডব্যাংক ভাবী’, জনতা ব্যাংক ভাবী ‘ডাক্তার ভাবী’ মানে হচ্ছে, যে ভাই ডাক্তার তার বউ

আরেকজন বলেছেন, ‘When someone becomes the wife of a defence officer, she has to forget her name for the rest of her life as she would be known as Mrs.X,Y,Z. I hate that.’

অনেক পুরুষ পাঠক তাদের গঠনমূলক মন্তব্যে নারীর আত্মপরিচয় জনিত এই সমস্যাটির বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের উপলব্ধির, এবং সেইসাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে উঠা সত্ত্বেও তাদের সুক্ষ মানবিক বোধের পরিচয় দিয়েছেন,

‘লেখককে ধন্যবাদ এরকম একটি আপাত-দৃষ্টিতে-জানা-কিন্তু-সচেতনভাবে-উপেক্ষিত বিষয় নিয়ে সহজ ভাষায় আলোকপাত করার জন্য

আরেকজন বলেছেন, ‘আপনার জীবনচেতনা এবং আত্ম সচেতনতা যা অতি স্বাভবিক একজন নারীর পক্ষে, তার অনেকখানিই হয়তো প্রকাশ এবং প্রসার পেয়েছে আপনার দেশজ অবস্থান থেকে আপনার যেখানে জন্মভূমি, সেই বাংলাদেশে অধিকাংশ নারীই কি আংশিকভাবে হলেও স্বকীয় স্বাধীনতার কথা ভাবতে পারেন, এখনো?’

সত্যিকথা বলতে গেলে আমরা যারা এসব নিয়ে ভাবছি বা মত প্রকাশ করছি, তাদের সংখ্যা খুবই কম, বাংলাদেশের বেশিরভাগ নারীর জন্যই এসব চিন্তার অধিকার অর্জনও এখনো অনেক দূরের স্বপ্নমাত্র কিন্তু তাই বলে হতাশ হলে চলবে কেন?

আমার নিজের জীবনে একদিন যেসব অধিকার অধরা স্বপ্ন ছিল, আজ তা শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার মত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে এভাবেই এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাব আমরা এমন একটা সমাজের স্বপ্ন নিয়ে যেখানে নারীর আত্মপরিচয়ের সমস্যা হবে ‘এক দেশে এক রাজা ছিল’র মত পুরোনো গল্প

অনেকে ‘ভাবী’ সম্বোধনের কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা বলেছেন,

‘যে যেই নামে ডাকুক, আপনি তো আপনিই এটা আমাদের দেশের কালচার আপা, দুলাভাই, ভাইয়া ভাবী, চাচা চাচী, মামা মামী,বেয়ান বেয়াই,খালা খালু, ফুপু ফুপা- এই ভাবে আত্মীয়করণ করা আমাদের সামাজিক নিয়মে পড়ে আপনার পারিপার্শ্বিকতা যেখানে যেমন, সেখানে তেমনটি মেনে চলতে অসুবিধা কোথায়?’

অন্য একজন বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, যেখানে পরিচয়ের সূত্র একজন পুরুষ, সেখানে তার স্ত্রীকে আপা ডাকা একটু দৃষ্টকটু বিধায়, ভাবী ডাকাই সামাজিক রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে

পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘ভাবী’ ডাক নিয়ে আমার তেমন সমস্যা নেই আমার নানান সম্পর্কের একঝাঁক দেবর ননদ আছেন যাদের মুখের আদুরে ভাবী ডাক আমার ভালই লাগে, এবং আমাদের কালচারের এই সুন্দর দিকটা আমি অস্বীকার করছি না, ঠিক যেমন অস্বীকার করছি না আপা-দুলাভাই, চাচা-চাচী, মামা-মামী,বেয়ান-বেয়াই,খালা-খালু, ফুপু-ফুপা এই ডাকগুলোর সামাজিক রীতিকে, কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই সম্বোধনগুলো যথাযথ ভাবেই ব্যবহার করা হয়, কিন্তু ‘ভাবী’র ব্যাপারটা একটু ভিন্ন

আমার লেখায় আমি একটা ঘটনার কথা বলেছি যেখানে একজন মহিলার নামই আমি জানতাম না কারণ তাকে আমি সবসময় ‘ভাবী’ বলে ডেকে এসেছি, যদিও তার স্বামী আমার ভাই নন  এর ফলে আমাকে অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল অথচ পরিচিত যে কোন নারীর স্বামীকে আমরা দুলাভাই ডাকি না, কারণ পুরুষের নিজের পরিচিতি সমাজে একটা প্রতিষ্ঠিত বিষয় যারা কালচারাল সৌন্দর্যের দোহাই পাড়ছেন, তারা এই বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন এগুলো নিয়ে ঝগড়া করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু ভাববার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি

ব্যক্তিগতভাবে চিনিনা এমন বহু সুহৃদের মন-ভাল-করা উৎসাহ ব্যঞ্জক অজস্র প্রশংসাসূচক মন্তব্য এখানে উল্লেখ করলে নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মত শোনাবে তাই সেগুলোর কথা বাদ দিলাম, কিন্তু তাদেরকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের এই পথ চলায় সাথে থাকার জন্য, কারণ পথটা যথেষ্ট পিচ্ছিল করে রাখার মত মানুষের অভাব নেই, আপনারা হাত ধরে থাকাতে চলাটা সহজ হচ্ছে

পথ পিচ্ছিলের একটা নমুনা দেই একজন ‘ভদ্রলোক’ আমার সম্পর্কে, আমার জীবন সম্পর্কে কিছু না জেনেই আমাকে নিজের নামে পরিচিত হবার যোগ্যতা অর্জনের উপদেশ দিয়েছেন,

‘ভাববেন না কেন? ভাবা তো খারাপ না৷ ভাবা হলো লাইফ স্কিলস্ এ ক্রিটিকাল থিংকিং-এর পাঠ৷ … হা হা … যাই হোক আপনি যে আইডিন্টিটি ক্রাইসিসের বিষয়টা তুলে ধরেছেন—সেটা তখনই ঘুচবে, যখন আপনি আপনাকে সত্যিই যোগ্য করে তুলতে পারবেন৷ … একজন ভদ্রমহিলার হাজবেন্ড যিনি নিজেও ডাক্তার—আমরা ভদ্রলোককে ভাইজান বলে ডাকি৷ মানে বুঝলেন? মানে ওই মহিলা সত্যিই নিজের একটা পরিচয় তৈরি করেছেন৷ মহিলার নাম উনার অনুমতি ছাড়া উল্লেখ করা ঠিক না বিধায় উল্লেখ করলাম না৷ … আপনিও ঊনার মতো নিজেকে যোগ্য করে তুলুন৷ এসব কোন সমস্যাই থাকবে না৷ … তারপরেও অনেকে ভাবী বলবেন৷ সেটা অনেকটুকু আমরা যেমন আমাদের কন্যাকে মা বা পুত্রকে বাবা বলে ডাকি—তেমন আরকি৷ …আর নিজেদের যদি লেজকাটা করতে চান—কিছু বলার নেই! …’

তো কথা হলো, একজন ভিখারি পুরুষ, একজন ঠগ জোচ্চোর পুরুষেরও অধিকার আছে তার নিজের নামে পরিচিত হবার, কারণ সে পুরুষ, আর একজন নারীকে নিজ নামে পরিচিত হতে হলে ডাক্তার হতে হবে? অথবা ইঞ্জিনিয়ার? অথবা আর্কিটেক্ট? শুধু মানুষ হওয়া তার জন্য যথেষ্ট নয়? এইসব ধারণা নিয়ে আমরা প্রগতিশীল সমাজ গড়ব?

আমি শিক্ষাগত বা পেশাগত জীবনে নিজের কষ্টার্জিত, সংগ্রামলব্ধ যোগ্যতার তালিকা দিতে যাবনা কারণ আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের, হোক সে নারী অথবা পুরুষ, আত্মপরিচয়ের অধিকার রয়েছে, যা পেশাগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ নয় প্রতিটি মানুষ জীবনে শিক্ষা ও সমৃদ্ধির সমান সুযোগ সুবিধা পায়না, কাজেই মানুষের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে পেশাদারী যোগ্যতার বিষয়টি অসম, অন্যায্য এবং অনাকাঙ্খিত

উপরের মন্তব্যের একটি সুন্দর জবাব উঠে এসেছে আরেকজন আধুনিক নারীর বক্তব্যে,

‘আমি বিয়ের পর কয়েকজনকে বলেছিলাম আমাকে ভাবী না ডেকে নাম ধরে ডাকতে সবাই খুব হাসাহাসি শুরু করেছিলো বললো, উনি এখনো ইয়ং থাকতে চানআমি সব কিছুর পরেও আমিই থাকতে চাই আমি কারো মেয়ে, বোন, বউ, মা অবশ্যই, তবে আর সবার আগে আমার নিজস্বতা

এই প্রসংগে একজন মুক্তমনা পুরুষের মন্তব্যে আমি আশার আলো দেখেছি,

‘শ‌িক্ষার সাথ‌ে মানসিতার ত‌েমন সম্পর্ক ন‌েই পর‌‌িচ‌িতি ন‌িয়‌ে আপনার লেখাটা সময়‌োপয‌োগী, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এমন ল‌‌েখায় এরকম সমাল‌োচনা ( সাড়া বলাই ভাল) প্রত্যাশিত, এমন সাড়া ল‌েখনীর স্বার্থকতা আর‌ো বাড়ায়, এমন বক্তব্যে উৎসাহ বাড়া উচ‌িৎ

তাই শিক্ষার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মিসজিনিস্টদের বলবো, মুক্তমনা মানুষের চোখে নিজ নামে পরিচিত হতে ইচ্ছুক নারী মানেই ‘লেজকাটা’ নয়, বরং সে একজন চিন্তাশীল মানুষ আর আমরা যারা এসব ভাবনা প্রকাশ করার সাহস সঞ্চয় করেছি, এই সাহসই আমাদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা আমরা চেঁচিয়েই যাবো, যতদিন না পৃথিবীর সকল নারী সকল মানুষ এই যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হবেন  আর সবকিছুর পর, আপনারকেও ধন্যবাদ কারণ বনে যদি মোষই না থাকে, আমরা কী তাড়াব?

শেয়ার করুন: