জীবন কখন সুন্দর- বাহুল্যে, নাকি স্বস্তিতে?

শারমিন শামস্: আমার পরিচিত কিছু বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয় আছেন বড্ড পণ্যলোভী। এরা জীবনের একটা বিরাট অংশ পণ্যের পিছনে ছুটে পার করে দেন।  কখনো নতুন মডেলের মোবাইল, কখনো আইপ্যাড, কখনো এলইডি টিভি, কখনো নতুন মডেলের গাড়ি এদের চিন্তার জগৎ দখল করে রাখে। সেই চিন্তার জগতে পণ্যটির প্রতি ভালোবাসা বা আকর্ষণের চেয়েও নিজেকে আশেপাশের লোকেদের সঙ্গে মেশার উপযুক্ত করে তোলার বাসনা আর জাতের ওঠা প্রতিযোগিতাটাই মুখ্য।

Moonmoon-edited
শারমিন শামস্

সহকর্মীর হাতে লেটেস্ট মডেলের মোবাইল দেখলে, এরা নিজের কিঞ্চিত পুরোনো মোবাইলখানা চট করে জামার আস্তিনের নিচে লুকিয়ে ফেলে। তারপর দিনে রাতে শয়নে স্বপনে দিনরাত সেই নতুন মোবাইলটা পাওয়ার ধ্যান করতে থাকে এবং সেটা অর্জনের পরই সে সভ্য সমাজে নিজেকে উপযুক্ত বলে মনে করে। অতঃপর সেই মোবাইল সকলকে দেখিয়ে তৃপ্তিতে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে।

এদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এ জাতীয় মানুষ বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে খাওয়াকে মনে করে জাতে ওঠা। কোন একটা বড় রেষ্টুরেন্ট আছে, সেটাতে সবাই যাচ্ছে, চেক ইন দিচ্ছে, কিন্তু সে এখনো যেতে পারে নাই, এই বেদনায় তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। যেকোনো মূল্যে কারো ঘাড়ে চেপে হলেও সেখানে একবার যেতে পারলে তার জীবন ধন্য হয়ে যায়।

এরা একটা নির্দিষ্ট দামের নিচে পোশাক কেনেন না। নির্দিষ্ট দোকানের বাইরে শপিং করেন না। তাদের আলমারি ভরে ওঠে বিশ ত্রিশ চল্লিশ থেকে লাখ টাকা দামের পোশাকে। কেন কেনেন? পোশাকটা সুন্দর বলেই? সবসময় তা নয়। এর নিচে পোশাক কিনলে সেই পোশাক বিশেষ বিশেষ সার্কেলে পরার উপযুক্ত হয় না। কমদামী পোশাক কাউকে দেখানোও যায় না।

এরা সাধারণত ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ায়। নিজেকে ছিবড়ে করে হলেও এর খরচ জোগাড়  করে। তার কারণ এই নয় যে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি ভালো বলে মনে করছেন। এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তার চেয়ে তার মনে এই ভাবনাই প্রকট হয়ে ওঠে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো মানে জাতে ওঠা ও জাতে থাকা। এটি না করলে সহকর্মী বন্ধু বা আত্মীয়দের মাঝে তার মান থাকবে না বলেই তিনি ধরে নেন। সন্তানকে কোন স্কুলে পড়ানো হচ্ছে, তার উপরেও নিজের জাতে ওঠা নির্ভর করে বলেই তাদের মস্তিষ্ক জানান দেয়।

একটু বয়স একটু বাড়লেই, তা খুব বেশি নয়, ত্রিশ পার করেই, এরা জমি এবং অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য হন্যে হয়ে ওঠেন। যদি কিনতে না পারেন, তবে বিষন্নতায় ভুগতে থাকেন। যেভাবেই হোক রাজধানীর বুকে জমি, বাড়ি আর অ্যাপার্টমেন্টের বিষয়টা পাকা করে ফেলতে পারলেই এরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

এ জাতীয় লোকজন যেকোন বন্ধু, আত্মীয় বা সহকর্মীর বাসায় এসেই সেই বাসার নতুন সোফা, নতুন পর্দা, বাসন কোসন, টিভি, ফ্রিজ, এসি এসব দেখতে ব্যস্ত হয়ে যান।

এসব নিয়ে নানা প্রশ্ন করেন, যেমন- কবে কিনলেন, কত দাম, কোত্থেকে কিনলেন, আগেরটা কোথায় ইত্যাদি। বাড়ির মালিক তাতে খুশি হচ্ছেন বলেই তারা ধরে নেন। আর খুশি না হলেও তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। অতঃপর তারা বাড়ির মানুষগুলোর দিকে তাকান। সেই মানুষটা কী পোশাক পরে আছেন, তিনি জিমে যাচ্ছেন কী না, পার্লারে শেষ কবে গেলেন- পরবর্তী ধাপে এগুলো তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বলা বাহুল্য, সেই বাড়ির নতুন পণ্যটা যদি তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে হয়, তবে তিনি আবারো অসুস্থ হয়ে পড়েন।

আমি এইসব মানুষের সন্তানদেরও এভাবেই ভাবতে দেখি। তারাও এভাবেই জীবনযাপন অনুশীলন করে। তারাও নতুন গ্যাজেট, নতুন খেলনা, নতুন সাইকেল, নতুন পোশাকের জন্য অস্থির হয়ে থাকে। না পেলে জিদ রাগ অভিমান করে। সপ্তাহে দু’তিনবার দামি দামি  রেস্টুরেন্টে না খেলে তাদের মন ভারি হয়ে থাকে। তারা এভাবেই শিখে বড় হয়েছে, এটাকেই তারা জীবন যাপনের আনন্দ আর সুখের সংজ্ঞা বলে জানে।

আমার চারপাশে এমন মানুষ, এমন পরিবার হাজারটা আছে। এরা আমাকে ক্লান্ত করে। আমার বারোশ টাকার সুতি শাড়ি আর ধ্যাদ্ধেরে মোবাইল ফোন আমাকে বিচলিত করে না, কিন্তু এরা আমাকে ভালোবাসে বলেই আমার জন্যও বিচলিত হয়। আমার সন্তান স্মার্ট ফোন ধরতে শেখেনি। সে এর কিচ্ছু বোঝেনা বলে তারা হা করে তাকায়। কিন্তু আমি তো সুখী।

আমার বুড়ো হয়ে যাওয়া গাড়িটা যখন গোঁ গোঁ শব্দ করে বড় রাস্তা ধরে এগোয়, আমার কন্যা তখন অবাক হয়ে আকাশের মেঘ দেখে, কৃষ্ণচূড়া ফুলের লাল দেখে আর লাল নীল বেলুনের জন্য হাত বাড়ায়। ঠাকুরমার ঝুলি আর জ্যাক এন জিলের গল্প কিনে আমরা বাড়ি ফিরি আর ভাবি, জীবন কখন সুন্দর? বাহুল্যে? নাকি স্বস্তিতে?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.