শান্তা মারিয়া: আসুন আজ আমরা ভালো ভালো কথা বলি আর একজন ‘ভালো মেয়ের গল্প’ শুনি। ‘ভালো’ বাবা-মায়ের সংসারে তৃতীয় কন্যা সন্তান হিসেবে জন্ম হয়েছিল মেয়েটির। তার নাম ইতি রেখে বাবা-মা চেয়েছিলেন ঘরে কন্যার আগমন ঠেকাতে। পারেননি বলা বাহুল্য। পরে পরে আরও দুটি বোন জন্মেছিল তার। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বোনের পর বহুল প্রতীক্ষিত পুত্র সন্তানের শুভ আগমন।

তার আগমন উপলক্ষে গর্বিত পিতা ঘোষণা করলেন, তার সব সম্পত্তি তিনি নবজাত পুত্রকে দিয়ে যাবেন। গর্ভভার জর্জরিত মা-ও একথায় সানন্দে স্বীকৃতি দেন। কারণ তিনিও ছিলেন ‘ভালো স্ত্রী’। মুরগির রান তো বটেই, বড় মেয়ের পাতে ছোট একটা টুকরো দিয়ে প্রায় পুরো মুরগিই তিনি ঢেলে দিতেন ছেলের পাতে। বাকি মেয়েদের কপালে জুটতো আলু আর ঝোল। মেজো বোন প্রতিবাদ করায় তার পিঠে কিলও পড়তো। মেজো বোনের পিঠে কিল পড়তে দেখেই পেট ভরে যেত ইতির। তখন থেকেই সে ‘ভালো মেয়ে’।
পাঁচ বোনই সরকারের খরচে সরকারি স্কুলে পড়তো। কারণ মেয়েদের পিছনে টাকা ঢালা পছন্দ করতেন না বাপজান। বিশেষ করে বংশের বাতির আগমনের পর থেকে এই ভস্মে ঘি ঢালা তার অসহ্যবোধ হতো। আদরের ছেলেকে টাকা পয়সা খরচ করে তিনি পড়াতেন ইংলিশ মিডিয়াম ওরফে ইংরেজি-মাধ্যম মাদ্রাসায়। প্রাইমারি স্কুলেরই এক শিক্ষক আবার ছিলেন মায়ের গ্রাম সম্পর্কের ভাই। তিনিই পাঁচ বোনকে পড়াতে আসতেন বাড়িতে। সেই সুযোগে মায়ের সঙ্গে হাসি গল্প তামাশা, বড় মেয়ের সঙ্গে একটু প্রেম-প্রেম ভাব আর ছোটদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ‘আদর’ করতেন।
এই ‘আদরের’ প্রতিদানে মেজো বোন একবার সপাটে চড় কষিয়েছিল তাকে। ফলাফল: মায়ের হাতে বেধড়ক পিটুনি বেয়াদবির শাস্তি হিসেবে। ওই বেধড়ক পিটুনি দেখার পর ইতির শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল। ‘হারামির পুত’ (তাকে এই নামে ডাকতো মেজো বোন) যত খুশি ‘আদর’ করুক, ‘ভালো মেয়ে’ ইতি কখনও আপত্তি করেনি।
অন্য চাকরি পেয়ে ‘হারামির পুত’ ইতিদের শহর ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল সে। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যেই অন্য এক ‘আদর’ করনেওয়ালার আগমন। এবারের আদরশীল ব্যক্তি হলেন বড় দুলাভাই। মানে বড় বোনের স্বামী। এবারে ‘আদরের’ নাম ‘ঠাট্টা’।
এসএসসি পরীক্ষার পরই বড়বোনের বিয়ে দেওয়া হয়, কারণ এতোগুলো মেয়ে এক এক করে পার করতে হবে তো।
‘ভদ্র ও শান্ত’ বড় বোন বিয়েতে এক কথায় রাজি, তা হোক না বর তার চেয়ে পনের বছরের বড়। বাবা চেয়েছিলেন এক খরচেই মেজো মেয়েরও বিয়ে দিয়ে দিতে ওই বাড়িরই আরেক ছেলের (বরের চাচাতো ভাই) সঙ্গে। কিন্তু বেয়াদপ মেজো মেয়ে ব্যাপক চিল্লাপাল্লা করে সে পথ বন্ধ করে দেয়। বাসর রাতেই বরকে খুন করবে এমন হুমকিও দেয়।
সে অবশ্য বরাবরই খুব ‘খ্রাপ’(খারাপ)। মেজো শালীর ভাবগতিক দেখে দুলাভাই তার সঙ্গে ‘ঠাট্টা তামাশা’ করার আশা ত্যাগ করেন। তার পেয়ারের শালী হয় ইতি। তার সঙ্গেই চলে যাবতীয় ‘ঠাট্টা’। যতই ঠাট্টা করুক, দুলাভাই অবশ্য খুব ‘খ্রাপ’ ছিল না। সে নিজের এক পরিচিত লোকের সঙ্গে ইতির বিয়ে ঠিক করে ফেলে এইচএসসি পরীক্ষার আগেই। বিয়েতে খরচাপাতিও করে। বড় জামাইয়ের এই মহানুভবতায় শ্বশুর শুধু কৃতজ্ঞ নন, রীতিমতো মুগ্ধ। মেজো মেয়েকে বাদ দিয়ে সেজো মেয়ের বিয়ে, মা একটু খুঁত খুঁত করছিলেন। কিন্তু কী করা যাবে, বেয়াদপ মেজো মেয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা করে ঢাকায় গেছে বাপের চরম আপত্তি পায়ে ঠেলে।
সেখানে সে কোন্ এক এনজিওতে ছোট একটা চাকরি করবে, আর পাশাপাশি কলেজে পড়বে। এমন ‘খ্রাপ মেয়ের’ নাম মুখে আনাও পাপ। অন্য দেশ হলে নাকি তাকে গলা টিপে মেরেই ফেলা হতো পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য। কিন্তু হায়, বাংলাদেশে এখনও তেমন সুযোগ নেই।
বিয়ের আগেই ইতিকে দুলাভাই হালকা টাচ দিয়ে রেখেছিলেন তার হবু বর সম্পর্কে। বর ঢাকায় থাকে। সে নাকি খুব ‘ধার্মিক’। আর তাদের বাড়িতে ‘পর্দা’ মেনে চলতে হবে। সেই পর্দা যে এতো ঘোরতর, সেটা অবশ্য ইতি আগে বুঝতে পারেনি। মালয়েশিয়ান ফিটিং বোরখা নয়, রীতিমতো সৌদী বোরখা। চোখ বের করা যাবে, তবে নাক-মুখ নেকাবে ঢাকা। হাতে-পায়ে কালো মোজা। এর উপরও আবার গায়ে একটা হালকা চাদর জড়াতে হবে। ইতি এসবেও আপত্তি করেনি। বাসর রাতে স্বামীকে পায়ে হাত দিয়ে সালামও করেছে। স্বামীর ‘সহবত’ও মুখ বুজে সহ্য করেছে। শুধু সহ্যই না, তার একটু একটু ভালোও লেগেছে। অন্তত দুলাভাইয়ের ‘ঠাট্টা’র চেয়ে ভালো।
বিয়ের কয়েকদিন পর মোবাইলে আর কম্পিউটারে স্বামী তাকে কয়েকটি ভিডিও দেখিয়েছে। সেগুলো নাকি ‘ইস্তিরি’দের দেখতে হয় স্বামীকে ‘খুশি’ করার জন্য। তা ইতি নিজে খুশি হয়েছে, খুশি করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কারণ সে ‘ভালো মেয়ে’ ছিল, আর এখন ‘ভালো বউ’ হয়েছে। তাছাড়া তার স্বামী খুব ‘খ্রাপ’ না।
ভিডিও দেখা আর বাড়ির কাজের মেয়েটির সঙ্গে ‘আদর-সোহাগ’ করা ছাড়া আর কোনো খারাবি তার মধ্যে নেই। তবে কাজের মেয়ে হলো ‘বান্দি’। স্বামীর পীর হুজুর নাকি বলেছেন, ‘বান্দির সাথে এসব আচরণ করা জায়েজ’। পীর হুজুর মাঝেমধ্যে ইতিকেও ‘নসিহত’ করেন। ইতি তাতেও আপত্তি করেনি। এই ‘নসিহত’ নিতে হয় একা একা শুধু পীরহুজুরের কাছে। স্বামীকেও বিস্তারিত তার ‘নসিহত’ বিষয়ে বলেনি। ইতির উপর নাকি পীরহুজুর দারুণ সন্তুষ্ট। ফলে স্বামীও খুব খুশি।
স্বামী বলে, তার কপাল ভালো, তাই এমন ‘ভালো ইস্তিরি’ পেয়েছে। তার ছোট ভাইয়ের কপাল খারাপ। তার ‘ইস্তিরি ভালো না, খ্রাপ’। সেই ‘বেহুদা মেয়েলোক’টি নাকি তার স্বামীকে ছেড়ে যেতে চাইছে, আবার চাকরি-বাকরিরও চেষ্টা করছে, যেখানে নাকি প্রচুর পর-পুরুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে।
ইতির স্বামী দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করেছে। ইতির সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য অনেক। তাতে কী, তার তো বেশ টাকা-পয়সা আছে। ইতিকে সোনার গয়না দিয়েছে, ঢাকা শহরে আরাম-আয়েশে রেখেছে। ইতির বাবার কাছ থেকে যৌতুক নিয়েছে। তা সেটা তো নিবেই।
তবে বিয়ের পর সে আর তেমন টাকা পয়সা চায়নি। বরং ইতির হাতে মাঝে মধ্যে টাকাও দেয়। তাদের গাড়ি আছে। যদিও ইতি একা খুব একটা বাইরে যায় না। গাড়িতে চড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যায় মাঝে মধ্যে। আর যায় গাউছিয়ায়। ইতির ‘কপাল ভালো’। তার প্রথম সন্তান ছেলে। ‘ভালো বউ’দের প্রথম সন্তান ছেলেই হয়। যেমন তার ছোট জা ‘ভালো মেয়ে’ নয়। সে পর্দা মানতে চায় না, কলেজে পড়ালেখা করেছে। তার প্রথম সন্তান হয়েছে ‘মেয়ে’।
ইতি তাতে বেশ খুশি হয়েছে, কারণ ‘খ্রাপ মেয়েদের’ শাস্তি হওয়াই উচিত।
ইতি আজকাল গাড়িতে করে ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যায়। যদিও সে পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে না, তবে অন্য মহিলাদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আলাপ করে। গাড়ির ভিতর দিয়ে রাস্তাঘাটে অনেক বেপর্দা মেয়েকে দেখে। ছি: ছি:। ‘মেয়েলোকরা’ এভাবে বেপর্দা চলবে কেন? এজন্যই তো শোনা যায় বাসে, ট্রেনে নাকি ‘বেপর্দা মেয়েলোকদের’ গায়ে পর-পুরুষরা হাত দেয়। দিবেই তো। ওরা তো খ্রাপ মেয়ে। ওদের গায়ে তো পুরুষরা হাত দিবেই।
অবশ্য বেশ কয়েকদিন গাউছিয়া মার্কেটে ইতির গায়েও বেশ কয়েকজন পুরুষ হাত দিয়েছে, বোরখা পরা দেখেও রেয়াত করেনি। তবে শরমে এসব কথা সে কাউকে বলেনি।
যাই হোক ইতি ভালোই আছে। ভালো মেয়েরা ভালো থাকবে এটাই তো স্বভাবিক।
প্রিয় ‘ভালো এবং খ্রাপ’ পাঠক, ইতির নামটা কাল্পনিক, কিন্তু ঘটনাগুলো যে সর্বৈব সত্যি সে সম্পর্কে গ্যারান্টি ও ওয়ারেন্টি দিতে পারি। এই ভালো মেয়েটি আমাদের খুব পরিচিত, তাই না? এই তথাকথিত ‘ভালো নারীরা’ই হলেন পুরুষতন্ত্রের স্তম্ভ বা মজবুত ‘খাম্বা’। পুরুষতন্ত্র এই খাম্বাদের উদাহরণস্বরূপ প্রদর্শন করে খারাপ নারীদের সাইজ করে।
তারা খারাপ নারীদের গায়ে পাথর ছুঁড়তে, তাদের বধযোগ্য ঘোষণা করতে এবং ধর্ষণসহ সব রকম নির্যাতন করতে দ্বিধা করে না। সেই কাজে তারা নৈতিক সমর্থন পায় এইসব ‘ভালো’ নারীদের কাছ থেকে। যে নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়, যে নারীর কণ্ঠ প্রতিবাদ করে, যে নারীর হাত সপাটে চপেটাঘাত করে পুরুষতন্ত্রের বদনে, যে নারী স্বাধীন জীবিকা অর্জন করে নিজের ইচ্ছায় সেটা ব্যয় করতে চায়, যে নারী পুরুষের ‘আদর’, ‘ঠাট্টা’, ‘সহবত’, ‘নসিহত’ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না, বরং সেটা সবলে প্রত্যাখ্যান করে, সেই নারীর কপালে এঁকে দেওয়া হয় খারাপ মেয়ের ট্রেডমার্ক। তখন সেই নারীকে চাইলে সমাজ থেকে বের করে দেওয়া যায়, তাকে ধর্ষণ করা চলে, তাকে হত্যা করা যায় অবলীলায়। আর এসব দেখেও ভালো নারীরা চুপ করে থাকে।
মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। খারাপ নারীদের পরিণতি দেখে তারা মনে মনে স্বস্তিÍর নিঃশ্বাস ফেলে আর ভাবে ‘নাহ আমার সঙ্গে কখনও এমন হবে না। আমি তো ভালো’।
ঘুঁটে পোড়ে আর গোবর হাসে। হায় রে ভালো নারী। তোমার ভালোত্ব ঘুচাও। কত আর পুরুষতন্ত্রের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচবে? কত আর তোষামোদ করবে তোমার পুরুষ প্রভুকে? খারাপ নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখো, থুথু দাও পুরুষতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া ভালো নারীর সংজ্ঞার মুখে, নিজের জীবনকে গড়ো, বেরিয়ে আসো তোমার ভালোত্বের কোকুন থেকে, শুঁয়োপোকা হয়ে আর কতো সমাজের নির্ধারিত ভালো মেয়ের চাদরে মুড়ে রাখবে নিজেকে?
এবার প্রজাপতি হও। বাঁচতে শেখো স্বাধীনভাবে, নিজের ইচ্ছায়, নিজের মর্যাদা নিয়ে, প্রতিবাদ করো সকল অন্যায়ের। নিজের মনকে দাস বানিয়ে ফেলো না। নিজে না পারো, অন্তত প্রতিবাদী নারীর সৎ সাহসকে সাধুবাদ জানাতে শেখো, তাকে সমর্থন দাও, তার পাশে দাঁড়াতে সাহসী হও, তবেই যদি মানুষের জীবন যাপন করতে পারো।