রিয়াজুল হক: ১. এক সাতের আগে জঙ্গী হিসেবে যারা ধরা পড়েছে–তাদের অনেকেই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। কিংবা কেউ কেউ সাধারণ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। জঙ্গিদের হাতে যারা নিহত হয়েছে-তাদের প্রায় সকলেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কেউ ব্লগার, কেউ লেখক, কেউ প্রকাশক। এদের বাইরে যারা জঙ্গিদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন-তারা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী, ধর্মীয় গুরু কিংবা একই ধর্মের ভিন্নমতের অনুসারী। কিন্তু তাদেরও অবস্থান ছিল মধ্যবিত্তে বা নিম্নবিত্তে।

তার মানে জঙ্গিদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মানুষ কিংবা জঙ্গি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা মানুষ-কেউ এদেশের উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য ছিল না। তাই তারা বেশ আয়েশেই ছিল, আরামে ছিল। বিত্ত-বৈভবে সুখেই ছিল তারা। বাংলাদেশের এই সমস্যা তাদের শরীরে আঁচ লাগাবে না বলে, তারা নিশ্চিত ছিল। তাই তাদের কাছ থেকে শোনা যেত-এটি মাদ্রাসার সমস্যা। এটি নিরক্ষরতার সমস্যা। এটি দারিদ্রের সমস্যা। এটি ব্লগারদের সমস্যা। এটি নাস্তিকতার সমস্যা। এটি লেখালেখির সমস্যা।
২. দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে-কলেজগুলোতে প্রায়শই রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়। নিরীহ শিক্ষার্থী মারা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ বন্ধ থাকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতি করে। নিজেদের দ্বন্দ্বে ক্লাস বন্ধ থাকে। বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত নিশ্চুপ। তাদের ভাবনা নেই, দুঃশ্চিন্তা নেই, সংকটও নেই। তাদের সন্তানরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা সরকারি-বেসরকারি কলেজে পড়ে না। তাদের সন্তানরা পড়ে দামি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাংলাদেশ, এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ এসব জেনে কী হবে? এগুলো হলো মধ্যবিত্তের প্যাচাল বা আবেগ। তার চেয়ে দরকার ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা, আর বাজার-উপযোগী দক্ষতা। শিক্ষা শেষে যোগ দেবে কোনো এমএনসি বা টিএনসিতে। তাদের সন্তানদের শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত হয় না। তাদের কারো সন্তান সন্ত্রাসীর অাখ্যা পায় না। তাদের পরিচিতির কোনো সংকট নেই। বাড়িতে এসি, গাড়িতে এসি, স্কুলে এসি। কষ্টের জীবন তাদের সন্তানদেরকে স্পর্শই করে না।
৩. দুই হাজার সালের পর থেকে শুরু হল ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, আরো কত অপারেশন। বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বাড়তেই থাকলো সব আমলে। তাতে বাংলাদেশের উচ্চবিত্তের কোনো সমস্যা নেই, সংকট নেই। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার-এ যারা মারা যায়, তাদের প্রায় সকলেই মধ্যবিত্তের বা নিম্নবিত্তের পরিবারের সদস্য। ওসব ল্যাটা চুকে যাওয়াই ভাল। তাদের সন্তানরা তো সন্ত্রাসীও হয় না, ছিঁচকে চোরও হয় না, বা ডাকাতও হয় না। ব্যাংকের অামানত লুণ্ঠনে, ঋণখেলাপে, টাকা পাচারে, ইনভয়েসিং-ওভারভয়েসিং-এ, কর ফাঁকি দিলে, কারাখানায় শ্রমিক মারা গেলে কখনও ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার হবে না। সে কারণে উচ্চবিত্তের ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার-এর নামে বিনাবিচারে মানুষ মারা নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই।
৪. রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়ে মারা যায়। দগ্ধ শরীর নিয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। পোড়া গন্ধে বাতাস ভারি হয়। তাতে বাংলাদেশের উচ্চবিত্তের কোনো সমস্যা নেই, সংকট নেই। আগুনে পুড়ে যারা মারা যায়, হয় তারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। দগ্ধ শরীর নিয়ে যারা কষ্টে বেঁচে আছে, তারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। পুলিশের লাঠি খায় মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। পুলিশের গুলিও খায় মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত। তারাই তো রাজনৈতিক কর্মী। পথের সৈনিক। নেতা নয়। নেতারা উচ্চবিত্তের বা উচ্চ মধ্যবিত্তের। তাদের সন্তানদের পথে নামার দরকার নেই। ছাত্রনেতা হওয়ার দরকার নেই। সময়মতো টিকিট পেয়ে অর্থ দিয়ে, পেশি দিয়ে ঠিকই জননেতা, এমপি, মন্ত্রী হয়ে যাবে।
৫. এক সাত সবকিছু পাল্টে দিল। হঠাৎ করে যেন বাংলাদেশের উচ্চবিত্তের সাজানো বাগানে বজ্রপাত হলো। দেখা গেল, জঙ্গীদের অনেকেই উচ্চবিত্তের সন্তান। তারা দামি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কেউ কেউ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। নিশ্চিন্ত জীবনে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। উচ্চবিত্তের শরীরে এবার লাগলো সন্ত্রাসী বা জঙ্গীর তকমা। গুলশানের রেস্তোরায় জঙ্গীদের হামলায় প্রাণ গেল বিদেশিদের, প্রাণ গেল দেশের মানুষদেরও। কিন্তু এবার নিহত দেশের মানুষদের মধ্যে বিত্তশালীরাই বেশি। জিম্মি হয়ে এক ভীতিকর রাত কাটালো উচ্চবিত্তের দেশি মানুষরাও। গ্রাম নয়, গঞ্জ নয়, শহর নয়, এমনকি বইমেলা বা ঢাকার মিরপুর, কলাবাগান নয়, হামলা হলো ঢাকার সবচেয়ে সুরক্ষিত বেসামরিক এলাকা গুলশানে। যে গুলশান ঢাকার তথা বাংলাদেশের আভিজাত্যের ও নিরাপত্তার প্রতীক। তার মানে বাংলাদেশের কোনো স্থানই নিরাপদ নয়। কোনো শ্রেণিই নিরাপদ নয়, নিশ্চিন্ত নয়।
৬. এই প্রথম বাংলাদেশে ফুলেফেঁপে ওঠা উচ্চবিত্তের মানুষরা এক মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক সংকটে পড়েছে। তাদেরকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিয়েছে এক সাতের ঘটনা। বাংলাদেশের কোনো সংকট থেকে তারা ও তাদের সন্তানরা বিযুক্ত নয়। গোটা বাংলাদেশকে অরক্ষিত রেখে, বঞ্চিত রেখে উচ্চবিত্তরা সুরক্ষিত থাকতে পারে না। কোনো কালে কোনো দেশে কখনই তা সম্ভব হয়নি।