সানজীদা খান: ১ম দৃশ্য: রহমান সাহেবের (ছদ্মনাম) মেয়ে রূপা (ছদ্মনাম)। যার বিয়ের প্রায় তিন মাসের মাথায় ডিভোর্স হয়েছে। রূপার বিয়েটা ছিল পছন্দের বিয়ে। বিয়ের আগে রূপার প্রায় ৬-৭ বছরের প্রেম ছিল। সেই প্রেম গড়ায় বিয়েতে। কিন্তু ৬-৭ বছরের প্রেমের বিয়ে তিন মাসেই শেষ হয়ে যায়। এখন কেউ যদি রহমান সাহেবের মেয়ে প্রসঙ্গে কোন কথা বলে সেই মেয়ের পরিচয়টা হয় এভাবে “কে, ওই যে রহমান সাহেবের ডিভোর্সী মেয়েটা?”
২য় দৃশ্য: আজহার সাহেবের (ছদ্মনাম) মেয়ে ঝর্ণা (ছদ্মনাম)। খুব আদরের মেয়ে তার। খুব শখ করে অনেক শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষিত ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন। কিন্তু সৌভাগ্য হোক আর দুর্ভাগ্য হোক বিয়ের তিন বছর পরেই বিয়েটা ডিভোর্স এর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই ডিভোর্স নিয়ে এখন অনেক কানাঘুষা চলছে। ঝর্ণার বান্ধবীরা তাকে নিয়ে আলোচনা করে এভাবে, ‘আরে জানিস ঝর্ণার তো ডিভোর্স হয়ে গেলো, বাচ্চাও আছে। আরে ওর তো জীবনটাই শেষ হয়ে গেলো!’
আমাদের সমাজে এই দৃশ্যগুলোর কমতি নেই, অথচ এগুলো নিতান্তই একটি পরিবারের অভ্যন্তরীন বিষয়। ডিভোর্স ব্যাপারটি খুব রসালো করে ফেলাটা আমাদের সমাজের মানুষের একটা স্বভাবজাত সমস্যা। এই ডিভোর্স কী একটা মেয়ের শুরু এবং শেষ? ডিভোর্স হওয়া মেয়ের কী আর কোন পরিচয় থাকতে পারে না?
স্কুলে যখন একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে ভর্তি হয় স্কুলের সময়টা দুজনের জন্যেই একরকম, পড়াশুনার ধরন এক, বই খাতা এক, টিফিনের সময় এক এবং ঠিক এভাবেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে এবং মেয়ের জন্য সব নিয়ম এক। স্কুল, কলেজ এর গণ্ডি পেরিয়ে যখন ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধ করছে সেখানে তো আর মেয়েদের কোন আলাদা সুবিধা দেয়া হচ্ছে না, একই নিয়মে পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা যার যার সিট বরাদ্দ করছে।
অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা বরং ফলাফলের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকছে। একটা ছেলে হয়তো স্নাতক পাশ করেই লেখাপড়ার ইতি টানলো, অথচ হয়তো একটা মেয়ে তখন পিএইচডি করছে, এফসিপিএস করছে, ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য ইংল্যান্ড-এ বাস করছে।
কিন্তু যখন বিয়ে হচ্ছে তখন এই অতি উচ্চশিক্ষিত মেয়েগুলোর পরিচয় হয়ে যাচ্ছে ‘গৃহিনী’। এই স্নাতক পাশ ছেলেটি হয়তো বলছে, ‘আমি ওমুক জায়গায় চাকরি করছি। আমার ওমুক জিনিসের ব্যবসা আছে, আরে কাজ করে সময়ই পাই না’ তখন ওই উচ্চশিক্ষিত মেয়েটির বর হয়তো বলছে, ‘আমার স্ত্রী কিছু করছে না, গৃহিনী’।
এখানেই কী শেষ? না, দৃশ্যের পরেও দৃশ্য থাকে। এই উচ্চশিক্ষিত মেয়েটির যদি কোনভাবে ডিভোর্স হয় তাইলেই কেল্লা ফতে! ওই মেয়ে ডাক্তার, নাকি ইঞ্জিনিয়ার, উকিল নাকি ব্যারিস্টার, শিক্ষক নাকি ব্যাংকার এসবের কেউ ধারও ধারবে না। তখন ওই মেয়েটির পরিচয় একটাই। সেটি হলো ‘ডিভোর্সী’। মানুষ তাকে খোঁচাবে, সে হবে অন্য মানুষের আলোচনার পাত্রী। সে যতো ভালো চরিত্রের মেয়েই হোক, তার চরিত্রের ১২টা বাজাবেই লোকজন।
সমস্যা কী ভাই বোনেরা? মেয়েদের জীবনের মাপকাঠি কী শুধুমাত্র বিবাহিত জীবনের সফলতা? যারা বিবাহিত জীবনে সফল তারাই আল্লাহর বান্দা আর যার ডিভোর্স হয়েছে সে কি মাটি ফুঁড়ে বের হয়েছে? মেয়েদের অন্য কোনভাবে আটকাতে না পেয়ে ‘বিয়ে’ নামক খাঁচা তৈরি হয়েছে। বিয়ে দিয়ে খাঁচায় বন্দী করে রাখা হউক। মেয়ে যদি খাঁচা থেকে বের হয়ে যায় ওই মেয়ের জীবন গেলো। তার আর উঠে দাঁড়াবার অধিকার নাই।
অথচ এই মেয়েগুলোর হয়তো বিভিন্ন রকম প্রতিভা আছে। এই প্রতিভাগুলো হয়তো আমাদের দেশ ও সমাজকে অনেক ধনী করে দিতে পারে কিন্তু না, আমাদের এসবের প্রয়োজন নেই। আমরা যেন মেয়েদের ছোট করেই জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাই। বিয়েটা একটা বন্ধন। দুটো মানুষ এবং দুটি পরিবারের মধ্যে বন্ধন। সবাই এই বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বন্ধনের ভিতরেই সুখ খুঁজে নিতে চায় কিন্তু যে বন্ধন মানুষকে সুখ দিচ্ছে না, প্রতিনিয়ত কষ্টে কষ্টে মৃত্যুর আগেই মৃত্যু ঘটিয়ে দিচ্ছে, সে বন্ধন যদি ছিন্ন হয়ে যায় তার জন্য শুধুমাত্র মেয়েটি কেন ঝামেলায় পরবে? ছেলেটি কিন্তু কোন আলোচনার বিষয় হয় না। এক বন্ধন ছিন্ন হলে আরেক বন্ধনে জড়াতে ছেলেটির হয়তো তেমন সময়ও লাগছে না, সমস্যাও হচ্ছে না। অথচ একটি বন্ধন থেকে ছিন্ন হওয়া একটি মেয়ে চায় আবার সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক, তার প্রতিভার বিকাশ ঘটুক, সেও হয়তো আবার একটি বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। কিন্তু আমাদের সমাজ এইসব মেয়েদের স্বাগত জানাতে ব্যর্থ।
আমরা তাদের জীবন আবার শুরু করার বদলে জীবন শেষ করে দিতেই যেন বেশী আনন্দিত। ছোট বেলায় বাংলা ছায়াছবির কিছু ডায়ালগ দেখতাম ‘মেয়েদের জম্মই হইছে পরের ঘর করার জন্য” “একটা বিবাহিত মেয়ে বাপের বাড়িতে আসবে শুধু লাশ হয়ে, তার আগে নয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কথায় বলে না ‘যা রটে তার কিছু তো বটে’।
সমাজে মেয়েদের অবস্থাই আসলে এসব ছায়াছবিতে উঠে এসেছে। এই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সমাজে মেয়েরা আর কত হেলায় ফেলায় বাঁচবে কে বলতে পারে!
তবে সমাজ ও সমাজের মানুষ যত হেলাফেলা করুক ‘ডিভোর্সী’ কোন মেয়ের পরিচয় হতে পারে না। সব মেয়ের বিবাহিত জীবন টিকে যাবে এমনটি ভাবার যেমন কোন কারণ নেই, তেমনি বিবাহিত জীবন টেকেনি বলেই মেয়েটি সমাজকে কিছু দিতে পারবে না, সেটাও ভাবার কোন কারণ নেই। আমরা জাতি হিসেবে সবসময় কেন যেন নিচের দিকে তাকাতে পছন্দ করি, অথচ দৃষ্টি থাকবে সামনের দিকে।
আমার বাবা সব সময় বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা মানুষের দুটো চোখ দিয়েছে এবং চোখ দুটো দিয়েছে সামনের দিকে। তিনি চাইলে আরও বেশী চোখ দিতে পারতেন, অথবা চোখ দুটো পিছনেও দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেটা করেননি সুতরাং চোখ যেহেতু সামনে আমাদের দৃষ্টিটাও সামনের দিকে রাখতে হবে।
আমরা সামনে দেখবো এবং পিছনের কথা স্মরণ করবো, কিন্তু পেছনে তাকাবো না।” ডিভোর্সী ই বলি আর বিবাহিত জীবন থেকে ছিন্ন হওয়াই বলি, এসব মেয়েরাও তাদের নিজ নিজ যোগ্যতায় পরিচিত হবার অধিকার রাখে। জীবন একটাই কিন্তু, জীবন একবারই শুরু হয় এবং শেষ হয় কথাটা ঠিক নয়। জীবন যখন খুশি যেভাবে খুশি শুরু করা যায় এবং একমাত্র মৃত্যুতেই জীবনের শেষ।