সতীত্বের মন্ত্র এবং ট্রু-লাভের হাতছানি

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা: সতীত্বের মন্ত্রের ঘোর তো আছেই এ সমাজে, সাথে আছে রোমান্সকে গ্লোরিফাই করে বোকামীর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার হাতছানি।

নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসা, চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা, ভালোবাসার জন্য নিজেকে বদলে ‘তার’ মনের মতো হওয়া- এসব বোকামীকে ‘সত্যিকার ভালোবাসা’ বা ‘ট্রু লাভ’ বলে সংজ্ঞায়িত করার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। নিজের জন্য বাঁচতে শেখাকে ‘স্বার্থপরতা’ বলে মানুষকে বিষন্নতা আর অপরাধবোধে ঠেলে দেওয়ার চর্চা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।

13563572_10208931465657406_557053163_nকবিতার কথা বলি। ওর ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। গল্প করেছিলাম অনেক্ষণ। ওর গাঁজার ঘোর তখনো কাটেনি পুরোপুরি। মায়াবী হেসে বলেছিলো, “আমি এখন গাঁজার উপরেই থাকি, কী হয় না হয় টের পাইনা”। কারণ দিনে ৭-৮ জন খদ্দের হয় শুনে আমি প্রশ্ন করছিলাম, “কী করে পারো? কষ্ট হয়না”? কবিতা ফরিদপুর শহরের যৌনপল্লীতে থাকা একজন যৌনকর্মী। ওর আসল নাম  কবিতা নয়। ওর নাম আমি জানি। বলতে মানা। ওখানে ওকে কবিতা নামেই জানে সবাই। অদ্ভুত সুন্দর দেখতে মেয়েটা। ওরকম উজ্জ্বল টানা চোখ আমি দেখিনি আর। সমাজ মেয়েদের যে ‘আদর্শ গড়নে’ দেখতে চায় ও সেরকমই। মাত্র ২০০ টাকা লাগে ওর সাথে শুতে। যেদিন সাত থেকে আটজন খদ্দের পাওয়া যায় সেদিন ওর আয় ভালো।

চট্টগ্রামের বিবির হাটে ছিলো ওর বাসা। যাকে ভালোবাসতো তার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলো। সে এনে বিক্রি করে দিলো টাংগাইল যৌনপল্লীতে। তিন বছর যৌনশ্রম দিতে হয়েছে পেটে ভাতে। কাপড়টাও পেত না। কোথাও বেরোবার, কারো সাথে কথা বলবার স্বাধীনতা ছিল না। শ্রম দিয়ে যা আয় হয় তাতে কোনো ভাগ ছিল না ওর। তিন বছর পর পালিয়ে ও এসেছে ফরিদপুরে। স্বাধীনতার আশায়। নিজের আয়, নিজের চলাচল আর কথা বলায় নিয়ন্ত্রণ পেতে। সেদিক থেকে সে সুখী এখানে এসে। ওর কোনো ‘বন্ধু’ও হয়েছে। এখানে বন্ধু হয় ওদের। বন্ধুদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে ওরা। ভালোবাসে।

কবিতাও স্বপ্ন দেখছে একদিন সংসার করবে কোনো এক বন্ধুর সাথে। ও দেখে এই বন্ধুদের সাথে খদ্দেরদের তফাৎ হলো ভালোবাসাবাসির। আর আমি দেখি তফাৎ হলো খদ্দেররা টাকা দেয়, বন্ধুরা দেয় না, কখনো-সখনো বরং নিয়ে যায়। খদ্দেররা ভালোওবাসে না, বাড়তি কোনো লেনদেনেও যায়না। বন্ধুরা ‘ভালোবাসে’ (আমি জানি না এর রকম কী), বিনিময়ে নিয়ন্ত্রণ চায়। কখনো গয়নাগাটিও। কবিতা আমার চেয়েও ভালো জানে এসব। তবু স্বপ্নটা সে নিজেকে নিয়ে দেখতে পারে না। এমন নিঃস্ব কাউকে নিয়ে দেখতে পারে না যাদেরকে সে চেনে না, দেখেনি কখনো অথচ হয়তো ওকে পেলে তাদের জীবন নতুন মাত্রা পাবে। এ ভাবনা ওর মনে ভুলেও উঁকি দেয় না।

ওর শুধু মনে থাকে কতো ঘৃণা ওর জন্য জমা আছে পরিবার আর সমাজে; মনে থাকে ‘কাছের মানুষ’গুলো কতো ঘৃণা করতে পারে ওকে-  একজন যৌনকর্মী বলে।
কোথায় সেই প্রেমিক? যার হাত ধরে কবিতা ‘সব’ ছেড়েছিলো? তার তো কাছের মানুষরা কাছেই আছে। হয়তো বিয়ে থা করেছে, করতেই পারে। প্রেমিক তো কখনো যৌনপল্লীর অধিবাসী হয় না। ও কি আর ‘নিজের শরীর বেচে’?

আর ছিল শিখা। এসেছিলো গার্মেন্টসে কাজের আশায়, কোনো ভাইয়ের হাত ধরে। এখনও বাড়িতে টাকা পাঠায়, ছোট বোনটাকে পড়াচ্ছে। সবাই জানে ও গার্মেন্টসে কাজ করে। শেষ ঈদে বাড়ি গিয়েছিলো বহু সাহস করে, বোরখা গায়ে দিয়ে। বাড়ি গিয়েও কারো সামনে আসেনি, যদি কোনো খদ্দের দেখে ফেলে তাহলে সর্বনাশ! খদ্দেরের কিন্তু কিচ্ছু না!
শহুরে অবস্থাপন্ন মেয়েরাও পিছিয়ে নেই বোকামিতে। নিজের ব্যক্তিগত যা কিছু সব শেয়ার করছে প্রেমিকের সাথে, এমন কি ফেসবুক-ইমেইল পাসওয়ার্ড, একাউন্ট, মোবাইল ফোন পর্যন্ত। ভালোবাসার সম্পর্কটার সম্মান রাখতে চাইলে এভাবে লেজে-গোবরে হয়ে নয়, আলাদা সত্ত্বা হয়েই নিজেকে মেলে ধরা চাই। নিজের খেয়াল রাখতে না পারলে অন্যের শক্তি হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই।

কবিতাকে বলেছিলাম আর কারো জন্য অপেক্ষা কর না, নিজের মতন করে স্বপ্ন দেখো। কিন্তু সে শক্তি কি ওর আছে? ওকে নিঃশেষ করতে কী না করেছি আমরা? এই সমাজের চেহারার যে ভয়াবহ রূপ ও দেখেছে তা কি আমার দেখা নোংরা রূপের ধারে কাছেও যায়? যে মানুষটার সাথে কথা বলে এসে টানা তিন রাত আমি ঘুমাতে পারিনি কষ্ট আর অপরাধবোধ মিশ্রিত অদ্ভুত এক বোধে- সে মানুষটার দিন-রাত-মাস-বছর কী করে কাটে? আমার একটা আলিঙ্গন ওকে আদৌ কি ছুঁতে পারে?

ওর গাঁজার ঘোর আমাদের এই ঘোরের কাছে কিচ্ছু না। চোখ কী দেখায় আর আমরা কী দেখি? মাথা কী তথ্য নেয় আর আমরা কী বুঝি? কী ভয়ানক অন্যায়ের দায় আমরা অবলীলায় চাপিয়ে দিচ্ছি ভুক্তভোগীর গায়ে। সিল মেরে দিচ্ছি তাকে অচ্ছুৎ হিসেবে। ঠেলে দিচ্ছি আরো আরও তলায়। আরও দূরে। একলা অন্ধকারে।
এক একটা মানুষের মান-সম্মান-স্বপ্ন-অনুভূতি, পুরো জীবন- শুধু তার শরীর কে-কবে-কেন-কিভাবে ছোঁবে তার উপরে ভিত্তি করে তৈরি হবে?? হতেই থাকবে?

একটা অসতর্কতার খেসারত জীবনভর দিতে বাধ্য করছি মেয়েগুলিকে। স্বপ্ন দেখার সাহসটুকু করার সুযোগ রাখিনি আমরা, এই সমাজের মানুষ গুলিই। সতর্কতার প্রয়োজন যেমন আছে, প্রত্যেকেরই দায়ও আছে। দায় মুক্তির জন্য কী করতে পারি তাও সবাই জানি। জানি যে তা নিজের কাছে স্বীকার করে দায়িত্বশীল হবার অপেক্ষা শুধু।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.