বিলকিছ ইরানী: ইদানিং ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসা আর স্টার প্লাস বন্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন দেশের পুরুষ সমাজ। তাও পিস টিভি বন্ধের অজুহাতে এ দাবি আরো জোরদার করা হচ্ছে। তাদের দাবি পিস টিভি বন্ধ করলে স্টার জলসাও বন্ধ করতে হবে। পিস টিভি ঠিক কি কারণে বন্ধ করা হয়েছে সেটা অনেকেই জানেন। সেটা নিয়ে কথা বলতে চাইনা।
স্টার জলসা বন্ধের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন তাদের ব্যাখ্যা, স্টার জলসা এবং স্টার প্লাস এই-জাতীয় চ্যানেল দেখলে নাকি সংসার ভাঙ্গে। পরিবারে অশান্তি শিক্ষা দেয়া হয়, কূটকচালি শেখে সবাই। আর বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালের নামে রাখা পোশাকগুলো কিনতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করে।
তা অবশ্য করেছে। তবে তা গুটি কয়েকজন। আর এর জন্য দায়ী মূলত পারিবারিক আগ্রাসী মনোভাব। পরিবার থেকে একজন সন্তান ঈদে তার পছন্দের যেকোনো কিছু দাবি করতেই পারে। তাকে সেটা দিতে না পারলে বোঝাতে হবে। তা না করে বাজে কথা বলে আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে মারধর করলে সেই সন্তান তো এরকম সিদ্ধান্ত নেবেই। এটাই স্বাভাবিক।
আর অনেকে বলেন এসব চ্যানেল নৈতিকতা শিক্ষা দেয় না। ঠিক কোন চ্যানেলটা নৈতিকতা শিক্ষা দেয় বলেন তো? আপনারা পুরুষরা অনেকে যখন চুপি চুপি পর্ন সাইট, অশ্লীল মুভি, অর্ধ উলঙ্গ ডান্স দেখেন, সেখান থেকে কোন নৈতিকতা শিক্ষা পান আপনারা?
স্টার জলসা, স্টার প্লাস বন্ধে উঠে পড়ে লাগছেন অাপনারা, পর্ন মুভি, পর্ন সাইট বন্ধে উঠে পরে লাগতে পারেন না?
পোশাকের জন্য আত্মহত্যার ঘটনা বছরে একবার কি দুইবার ঘটে। কিছুটা কাউন্সিলিং করলে এ সমস্যা থাকবে না। কই এ বছর তো তেমন ঘটনা শোনা যায়নি? কিন্তু এই পর্ণ সাইট আর অশ্লীল মুভির কারণে বিপথে যাওয়া কিছু তরুণ সমাজ যে প্রতিদিন ধর্ষণের মতো জঘণ্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে, প্রতিদিন ঠিক কতজন ধর্ষণের কারণে মারা যাচ্ছে কিংবা হত্যা হচ্ছে হিসাব নিশ্চই ভুলে যাননি? কেন আপনারা পর্ন সাইট বা অশ্লীল মুভির বিরুদ্ধে মাঠে নামেন না,
ভেবেছেন একবার? কেন গৃহিনীরা স্টার জলসা অার স্টার প্লাস দেখতে এতো অাগ্রহী, ভেবেছেন?
অাপনার ঘরের সহধর্মিনীকে তো মানুষ বলে মনে হয় না, মনে হয় খেলনা পুতুল, অাপনি যেভাবে চালাবেন সেভাবে চলবে, অার মা কিংবা বোনের প্রতি তো নজরও দেন না, মা কোনটা পছন্দ করে, বোন কী পেলে খুশি হয়, ভাবেনও না, যে সময় তাদের নিয়ে ভাববার বিষয়, সে সময় সুন্দরীদের পেছনে ঘুরেন, বান্ধবী কিংবা বউ বানাবেন বলে, অার বউ হয়ে গেল মানে সে অাপনার গোলাম, অাপনি যেভাবে চাইবেন সেভাবেই তাকে চলতে হবে!
(অনেক ছেলের মুখে এই কথা শুনেছি, এবং স্টার জলসা ও স্টার প্লাস বন্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন অধিকাংশ ছেলেরাই)।
গত ১১ জুলাই এক ভাই আমার ফেসবুকের কমেন্টে লিখেছেন -‘পুরুষ সম্প্রদায় নিজের রক্ত পানি করে টাকা উপার্জন করেন শুধু বাড়ির নারী সদস্যদের সুখের জন্য। স্ত্রী-সন্তানসহ অন্যান্য নারী সদস্যরা ভোগবিলাস করেন বাড়ির কর্তাব্যক্তি পুরুষ সদস্যের বহু কষ্টের উপার্জিত টাকা দিয়ে। সেই পুরুষরা যখন কাজ শেষে বাড়িতে ফিরেন, তখন আপনার পছন্দের টিভি সিরিয়াল দেখা মেয়ে সম্প্রদায় তাঁদের একটু সেবা করা তো দূরের কথা, উল্টো নানা ফুট ফরমায়েশ দিয়ে পায়ের উপর পা দিয়ে আয়েশ করে সিরিয়াল দেখেন’-
তার কথায় মনে হচ্ছে তিনি নারীকে টাকার বিনিময়ে মাপছেন! তার মতে, নারীরা পুরুষের সেবা করবে এজন্য পুরুষরা বিয়ে করেন! আর নারীরা ঘরে কোনো কাজই করেন না। এ ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন পুরুষদের বলছি, আপনারা টাকা উপার্জন করছেন বলেই নারী আপনাদের সেবা করবে? তাহলে তো বলা যায়, টাকা উপার্জন যদি মুখ্য হতো তাহলে নারীরা টাকা উপার্জন করে আপনাদের পুরুষদের বলতো, সেবা করো। তাই নয়কি?
অপনি পুরুষ সারাদিন বাইরে খাটেন বলেই বিনিময়ে কিছু টাকা পান, তাই বলে অাপনি মহাভারত জয় করে ফেলছেন, এদিকে অাপনার সহধর্মিনী যে অাপনার সংসারে দিন-রাত কাজ করে মরছে তা কিছু না? ও, এই কাজে তো অাবার টাকা দেয়া হয় না, তাই অাপনার কাছে সে মূল্যহীন। একদিন ওই নারী যদি ঘরে না থাকে, একটু খেয়াল করবেন তো, আপনার ঘর- সংসার-সন্তানের কী হাল হয়?
এ কথায় বোঝা যায়, যতই অাপনারা বলেন নারীরা সমাজে সুবিধা পাচ্ছে, অাসলে প্রতিটা ঘরেই নারীরা কোন না কোনোভাবে অবহেলিত।
একবার কি ভেবেছেন,একজন মানুষের বিনোদন দরকার অাছে কিনা? সেটা ঘরে কিংবা বাইরে? একজন মানুষ একা একা সারা দিন ঘরে বসে থাকলে তার মানসিক বিকাশ কী করে হবে? কিভাবে সে মন খুলে হাসবে, কথা বলবে? এভাবে থাকলে তো যেকোনো সময় অবসাদ, বিষন্ন কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়বে অাপনার প্রিয় নারী সদস্যটি। ভাবনার জায়গাটাও যে তার সংকুচিত হয়ে অাসবে!
অাপনি তো বাইরে চলে যান, চাকরি করেন কিংবা অন্য কোন কাজ অার বন্ধুদের সাথে অাড্ডা দেয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাই মন প্রফুল্ল থাকে, বুঝতে পারেন না বিষন্নতা কী।
ঠিক একজন নারীও যখন বাইরে চাকরি করেন, কিংবা বন্ধু-বান্ধবের সাথে অাড্ডা দেন, তিনিও প্রফুল্ল থাকেন, মানসিক যন্ত্রণা তাকেও ছুঁতে পারে না।
কিন্তু যারা চাকরি করেন না, বাইরে বের হন না, অাড্ডা দেয়ার সুযোগও নেই, ঘরে থাকেন একা একা, তাদের বিনোদন কোথায়? কই, অাপনি তো অাপনার পরিবারের ঐ নারী সদস্যকে নিয়ে প্রতিদিন তো দূরে থাক, সপ্তাহে দুইটা দিনও নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হন না? তাই ঘরে বসে স্টার জলসা কিংবা স্টার প্লাস দেখে একটু সময় কাটানো, বিনোদন পাওয়া ছাড়া অার কীইবা করার থাকে তাদের?
অাপনার মতো তারা যদি স্টার জলসা, স্টার প্লাস না দেখে চুপি চুপি এমটিভি, ইংলিশ অশ্লীল মুভি, অর্ধ উলঙ্গ হিন্দি সিনেমা, সানি লিওন কিংবা পর্ণ সাইট দেখতো? ভালো লাগতো তখন? (অবশ্য অাপনারা সবাই যে এসব দেখেন তা বলছি না, কিছু কিছু মানুষের কথা বলছি) স্টার জলসা অার স্টার প্লাসে অধিকাংশ নাটক ফ্যামিলি সমস্যা অার সমাধান নিয়ে, অন্যসব দেখার চেয়ে এগুলো দেখা ভালো নয় কি?
বলবেন ক্রিকেট আর ফুটবল খেলা দেখতে? একজন গৃহিনী ক্রিকেট আর ফুটবল খেলা দেখে কি মাঠে গিয়ে তা কাজে লাগাবে? আপনি কি দিচ্ছেন তাকে মাঠে যেতে?
নাকি বলবেন ডিসকভারি চ্যানেল দেখতে? এসব চ্যানেলের প্রতি তো তাদেরই আকর্ষণ থাকে যারা বাইরের জগতে বের হতে পারে। বাইরের পরিবেশে মিশতে পারে। কিছু শিখতে পারে।
ভেবে দেখেন তো, অাপনার মা, বোন কিংবা সহধর্মিনী যারা বাইরে যেতে পারেন না কিংবা অাপনি নিয়ে যেতে পারেন না, সারাদিন ঘরে একা একা থাকে, তারা কীসে বিনোদন পাবে? বলবেন, এসব দেখে সংসার ভাঙ্গে? ভাঙ্গবে না কেন? অাপনি যদি নিজে জেদ করে, রিমোট কেড়ে নিয়ে বলেন স্টার জলসা দেখতে দেবেন না, রিমোট নিয়ে খেলা দেখবেন অাপনি, কারণ খেলা অাপনার পছন্দ, কিন্তু খেলা তো তার পছন্দ নাও হতে পারে।
পৃথিবীর সবাই একরকম না, অথচ তাকে তার পছন্দের জিনিস দেখতে না দিয়ে উল্টো বলবেন স্টার জলসা দেখলে তালাক দেব, তো সংসার না ভেঙ্গে উপায় অাছে? অার বাংলা চ্যানেল এর কথা বলবেন? মানসম্মত নাটক হলে তা না দেখে যাবে কই? আর এসব চ্যানেলে তো সাংসারিক খুঁটিনাটির পাশাপাশি কিভাবে পরিবার রক্ষা করা যায় তাও দেখানো হয় সেখানে। এসব খুঁটিনাটি তো শত শত বছর ধরে আপনার আমার গোষ্ঠি সম্প্রদায় থেকেই চলে আসছে। তাই টিভি পর্দায় দেখানো হচ্ছে।
কেউ বলছেন দেশীয় চ্যানেল ভারতে সম্প্রচার করছেনা বলে ভারতীয় চ্যানেলও এ দেশে সম্প্রচার বন্ধ করতে হবে, সেটা ভিন্ন কথা। সেটা আপনারা আমরা দাবি করতেই পারি। কিন্তু এর সাথে নারীদের রুচি আর শিক্ষার প্রশ্ন তুলে, অপবাদ দিয়ে তার জেরেেএসব চ্যানেল বন্ধের দাবি যদি তোলেন তা তো মেনে নেয়া যায়না। সেক্ষেত্রে আমরাও বলতে পারি, এদেশে সকল পুরুষ আর তরুণ ধ্বংসের মূল কারণ পর্ণ সাইট, অশ্লীল ইংলিশ মুভি, হিন্দি সিনেমা, বন্ধ করুন। দাবি যদি তুলতেই হয় তাহলে এটার তুলুন।
কেন বিষয়টি পজেিটিভলি দেখছেন না অাপনারা? এমন আচরণ করছেন যেন মনে হচ্ছে স্টার প্লাস কিংবা স্টার জলসা দেখা একটি অপরাধ!
আপনার ঘরের নারী সদস্যটি আপনারই আপনজন। তাদেরও তো বিনোদন খোরাক প্রয়োজন। তাদেরকে জোর করে চাপিয়ে না দিয়ে একদিন একসাথে বসে আপনিও দেখেন না, কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়?
বাইরে বের হতে দিবেন না, নিজেও বেড়াতে নিয়ে যাবেন না, বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে অাড্ডা দিলেও খারাপ চোখে দেখবেন, অাবার ঘরে বসে একটু টিভিও দেখতে দেবেন না! এটা কি ধরনের অাচরণ?
হ্যাঁ, অামি নিজে স্টার জলসা কিংবা স্টার প্লাস দেখি না, দেখার সময়ই বা কোথায়? সময় পেলে হাসির নাটক, ডিসকভারি চ্যানেল, ক্রাইম পেট্রোল, সিনেমা কিংবা বাংলাদেশি ক্রাইম সিন অথবা নিউজ দেখি।
সারাদিন কাজ সেরে যখন সন্ধ্যায় কিংবা রাতে বাসায় ফিরি তখন দেখি অসুস্থ অামার মা’ একা একা ঘরের সব কাজ সেরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রিমোটটা হাতে নিয়ে স্টার জলসা কিংবা স্টার প্লাস কিংবা হাসি কান্নার কোন নাটক দেখছেন, কখনো তা দেখে হাসছেন কখনো বা কাঁদছেন, কখনো অাবার রাগও করছেন। নিজেকে সুস্থ রাখার বড় ঔষধ হচ্ছে মন খুলে হাসতে পারা।
একা ঘরে বসে থাকা মানুষটির এই সামান্য হাসিটুকুও কি অামাদের সহ্য হয় না? তাও কেড়ে নিতে হবে? বলুন তো, অামার পক্ষে কি সম্ভব মায়ের কাছ থেকে ওই মূহুর্তে রিমোট কেড়ে নেয়া?
সাংবাদিক, রেডিও টুডে