শাশ্বতী বিপ্লব: ইউকেতে দোলনের ঘরে ওঠা ঝড় এমন করে ভেঙ্গেচুরে দেবে জামালপুরের বীথির সংসার তা কেউ কখনো কল্পনাও করেনি। কেমন করেই বা করবে। দোলন বা বীথি, কেউ কাউকে যে চিনতোই না। তবুও ভবিতব্য তাদের সারাজীবনের জন্য ঝুলিয়ে দিলো একই দড়ির দুই প্রান্তে।
দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া স্মার্ট মেয়ে। বাবা মা সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি-গাড়ি সব আছে।

অন্যদিকে বীথি মফস্বলের মেয়ে। লেখাপড়াও সেখানে। শহুরে স্মার্ট বলতে যা বোঝায়, বীথি সেটা কখনোই নয়। স্বভাবেও একটু নরম, শারীরিকভাবেও কিছুটা দুর্বল। দোলন ও বীথির মাঝে একমাত্র যোগসূত্র আলম, বীথির স্বামী। দোলন ও আলম বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ডিপার্টমেন্টে পড়লেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঠিক বলা যাবে না।
পরিবারের পছন্দে দোলনের বিয়ে হয়ে যায় অনার্স পড়ার সময়েই। সজলের সাথে। মাস্টার্স শেষ হতে না হতেই পাড়ি জমায় ইংল্যান্ডে। কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে মাহির। সাজানো গোছানে সুন্দর জীবন দোলনের।
সুখের মাঝেও সজল আর দোলনের ইগো মাঝে মাঝে ঝামেলা পাকাতে থাকে। আর এই ফাঁকে হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো তাদের জীবনে ঢুকে পড়ে ক্রিস্টিনা, সজলের সহকর্মী। তরুণী সুন্দরী ক্রিস্টিনার স্মার্টনেসের সাথে কিছুতেই পেরে উঠে না দোলন। ইউকেতে এতো মানুষ থাকতে সংসারী সজলকেই মনে ধরলো ক্রিস্টিনার। এতোটা অবিবেচক মানুষ কীভাবে হয় দোলন বুঝতে পারে না।
ঝগড়া ঝাটি, কান্নাকাটি কোনকিছুতেই সজলকে ফেরাতে পারে না দোলন। ছেলে মাহিরের কসম দিয়েও নয়। সজলের এক কথা, “আমার ছেলে আমি বুঝবো, তোমাকে ভাবতে হবে না।” দিনে দিনে দূরত্ব বাড়ে। এদিকে মাহিরের সাথেও বেশ ভাব জমিয়ে তোলে ক্রিস্টিনা। দোলনের সংসারটা ভেঙ্গে যায় অবধারিত ভাবেই।
দেশে ফিরে আসে দোলন, একা। মাহির আসে না। সে মন খারাপ করে, কাঁদে। কিন্তু দোলনকে বিস্মিত করে দিয়ে মায়ের সাথে দেশে ফিরতে চায় না।
বাবার সাথে মাহিরের সম্পর্ক বেশ ভালো। এতোকিছুর মাঝেও সজল মাহিরের সাথে নিজের দূরত্ব তৈরি হতে দেয়নি। মাহিরের স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ডও ব্রোকেন ফ্যামিলির। মাহির অতোকিছু না বুঝলেও বাবা-মায়ের বিচ্ছেদকে সে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। মাহির দোলনকে বলেছে, “আমি তোমাকে দেখতে যাবোতো মা। বাংলাদেশে। রোজ ফোন করে কথা বলবো।তুমি মন খারাপ করো না।” দোলন দীর্ঘশ্বাস চাপে। বিদেশী সংস্কৃতিকে অভিশাপ দেয়। কিন্তু মাহিরের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জোরও করে না আর।
দেশে ফিরে কিছুদিন গুম মেরে থাকে দোলন। কোথাও বের হয়না। মানুষের কৌতুহল থেকে আড়ালে থাকতে চায়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। বাবার অনুরোধে যোগ দেয় একটি ইংলিস মিডিয়াম স্কুলে। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মিষ্টি মুখগুলো দোলনের ডিপ্রেশন কাটাতে সাহায্য করে।
বিশ্ববিদ্যালেয়ের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হতে থাকে ধীরে ধীরে। কিন্তু সবাই ব্যস্ত জীবন নিয়ে। খুব একটা সময় দিতে পারে না কেউ। শুধু আলম ছাড়া।
আলম এমনিতে পরিবার নিয়ে জামালপুরেই থাকে। সেখানেই চাকরি করে। আলমেরও একটি ছেলে, রুবেল।
জামালপুরে থাকলেও আলম মাঝে মাঝেই ঢাকায় আসে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের “বিশেষ” কাছের বন্ধুরা বেশিরভাগই ঢাকায় থাকে। এসব আড্ডায় আলম কখনও বউকে নিয়ে আসে না। বীথি মফস্বলের মেয়ে।সেটা নিয়ে আলমেন মনে গোপন অস্বত্ত্বি কাজ করে। তাছাড়া আড্ডার সাথে সমানতালে চলে গাজার আসর।
আড্ডার পাশাপাশি দোলনকেও সময় দিতে শুরু করে আলম। ফেসবুকতো ছিলই, ধীরে ধীরে দোলনই ঢাকায় আসার মুখ্য কারণ হয়ে ওঠে। রাতের পর রাত ফোনেও কথা চলে।
দোলনের সব কাজে আলম সাথে থাকে। আলমের গেঁয়ো ভাবটা দোলনের এখন আর খারাপ লাগে না। বরং ওর প্রতি আলমের সহমর্মিতা তাকে মুগ্ধ করে।নিজের নিঃসঙ্গতা ঘুঁচাতে আলমকে আঁকড়ে ধরে। ন্যায়-অন্যায় বোধ তেমন কাজ করে না। তাছাড়া, আলম দোলনকে বুঝিয়েছে, সে নিজেও সুখী নয়। বীথিকে নিয়ে নানা সমস্যার কথা বলে। দোলন ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই ক্রিস্টিনা হয়ে উঠতে থাকে। আর বীথি দোলন।
আলমের পরিবর্তন বীথি ঠিকই টের পায়। কিন্তু কীভাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এখানেও কান্নাকাটিতে কাজ হয়না তেমন। কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করে বীথি। তাতে আলম আরো বিরক্ত হয়।
দুই পরিবারের মধ্যে শালিস হয় কয়েক দফা। আলমের এক কথা। সে এই সংসার আর করবে না। আলমের চোখে ঘোর। দোলনের চোস্ত ইংরেজী বাচনভঙ্গী, আভিজাত্যময় চালচলনের সামনে বীথিকে বড়ই ম্লান লাগে। আলম লোভ সামলাতে পারে না। দু’জন মিলে অনেক নীতিকথা আলোচনার ভান করে। নিজেদের কুকর্মের পক্ষে যুক্তি আওড়ায়। আলম-বীথির সংসারটা ভেঙ্গে যায়।
আলম-দোলন বিয়ে করেছে।পরিচিত বন্ধুরা খুশীই হয়। ফেসবুকে অভিনন্দনের ঢেউ বয়ে যায়। বন্ধুরা ভাবে, বেশ হলো। দোলনটার একটা গতিতো হলো।
বীথির কথা কেউ ভাবে না। ভাববেই বা কেন? বীথিকেতো কেউ চেনেই না আসলে। মফস্বলে একলা অন্ধকারে বীথি জীবন্মৃতের মতো বেঁচে থাকে। বিশেষ করে যখন একমাত্র সন্তানকেও ধীরে ধীরে হাতছাড়া হতে দেখে।
আলম এখনও জামালপুর ছাড়েনি। চাকরীটা ওখানে। বদলীর চেষ্টা করছে। ছেলেকেও ভোলেনি অবশ্য। মাঝে মাঝে নিজের সাথে ঢাকায় নিয়ে আসে। দোলন সহ বেড়াতে যায় এদিক ওদিক। দামী রেস্টুরেন্টে খায়। সেলফি তোলে। বীথির ছেলে রুবেলের কাছে এসব নতুন। তার ভালো লাগে। রুবেলের সাথে দোলনেরও ভাব জমাতে সময় লাগেনা। রুবেলকে সে সত্যি কতটা পছন্দ করে আর কতটা আলমকে খুশী করার জন্য ভান করে সেটা অবশ্য স্পষ্ট বোঝা যায় না।
রুবেলের এই নতুন মাকে খারাপ লাগে না। কেমন সুন্দর করে ইংরেজী বলে। ও যদিও মা ডাকে না। ওর লজ্জা করে। গোপনে নিজের নিঃসঙ্গ মাকে মনেও পড়ে বার বার। কেমন ঘোরের মতো লাগে রুবেলেরও।
বাবা সারাক্ষণ তাকে বোঝায় দোলন কত ভালো। আলম সুচতুরভাবে রুবেলের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে থাকে তার এই বিয়ে করাটা কেন জরুরী ছিল। কেন সে তার মায়ের সঙ্গে থাকতে পারলো না।
ছোট্ট রুবেলের মাথায় অতোকিছু খেলে না। সে বাবাকে ভালোবাসে, তাই বাবার কথা মন দিয়ে শোনে। তবুও ঢাকা থেকে ফিরে মায়ের কাছে গেলে রুবেলের কেমন অপরাধবোধ কাজ করে। মা যখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে, তখন রুবেল ঠিকমতো উত্তর দিতে পারে না। ছোট্ট রুবেল এক জটিল মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে বড় হতে থাকে।
এদিকে আলমের পোশাক আশাকেও পরিবর্তন এসেছে। লোকলজ্জাও কাটিয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝেই ফেসবুকে দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠ ছবি পোস্ট করতে দেখা যায়। দোলনের স্ট্যাটাসে উঠছে সে ধীরে ধীরে। চোখে মুখে নির্লজ্জের সুখী সুখী ভাব।
ইদানিং ছেলের সাথেও বেশি বেশি ছবি আপলোড করে আলম। হয়তো দায়িত্ববান, স্নেহশীল পিতা হিসেবে দেখাতে চায় সবাইকে। অথবা নিজেকেই। কে জানে!!
ফেসবুকে বেশ লাইকও জোটে। লাইকের দায় নেই বীথির খবর নেয়ার। লাইকের দায় নেই বিবেচক হওয়ার। একটা লাইক বইতো নয়!!