সারাদেশের ‘কৃষ্ণপুর’ই যখন ‘রসুলপুর’  

সালেহা ইয়াসমিন লাইলী: গ্রামটির নাম এখনও কৃষ্ণপুর। কুড়িগ্রাম সদর পৌরসভার একটি গ্রাম। গ্রামটির নামকরণের কোন ইতিহাস খুঁজে পাইনি আমি। গ্রামটির আশেপাশের এলাকাগুলির নাম দেখে বোঝা যায় একসময় এ অঞ্চল হিন্দু অধ্যুষিত ছিলো। নিলারাম, পালপাড়া, সেনের খামার, বৈরাগীর বাজার, হিঙ্গনরায়, কালির হাট, দাশের হাট, যতীনের হাট, দুর্গাপুর, নামগুলো বলে দেয় যে অন্য ধর্মের মানুষের তেমন আধিপত্য এ অঞ্চলে ছিল না।

যদিও গুণে গুণে কয়েকঘর করে হিন্দু পরিবার এখনও গ্রামগুলোতে টিকে আছে। তবে Leeএখন আর এ গ্রাম কৃষ্ণের লীলা ক্ষেত্র নয়, নেই কোন কৃষ্ণের পুরীও। তাই গ্রামটির নাম বদলের দাবি উঠেছে জোরেশোরে। রসুল অনুসারীরা প্রস্তাব দিয়েছে, গ্রামটির নাম হবে এবার রসুলপুর।

শুধু গ্রামটির নাম বদলেই ক্ষান্তি দিতে চান না তারা। গ্রামের ভেতরের ছোট ছোট পাড়াগুলোরও নাম বদলের প্রস্তাব আসছে। নিলারামকে বেজির ভিটা নামে ডাকতে তারা পছন্দ করেছে। দাশের হাটের নাম বদলে ইতোমধ্যে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে দশেরহাট নামে। গ্রাম ও পাড়ার নাম প্রস্তাবে আছে মুন্সিপাড়া, কাজিপাড়া, মাষ্টার পাড়া এমন সব নাম। পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের সাধ্য থাকলে যেন একদিনেই এই ভুল সময়ের ভুল(!) নামগুলো উঠিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়।

এই গ্রামেরই একটি ঘটনা- এবার পহেলা বৈশাখে কৃষ্ণপুর গ্রামের নিলারাম স্কুল মাঠে বসবে কুশান ও পালাগানের আসর। স্থানীয় একটি গানের দলের  সাথে চুক্তি করা হয়েছে। ১৫ জনের দলটির দলনেতার সাথে কথা বলে তিন সপ্তাহ আগেই অগ্রিম টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। দলটি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে চুক্তিতে গান করে বেড়ায়। তাদের বেশ খ্যাতিও আছে দেশব্যাপী।

এই জেলার প্রাচীন সংস্কৃতি ও ভাষায় নির্মিত কুশান ও পালাগান দীর্ঘকাল ধরে দলটি বংশানুক্রমে চর্চা করে আসছে। কিন্তু জেলার ভেতরে ও জেলার আশেপাশে সাংস্কৃতিক আয়োজনগুলোতে তাদের কোন ডাক পড়ে না। বরং হিন্দুবাড়ির হরিসভা বা অন্য কোন পুজার অনুষ্ঠানকে ঘিরেই দলটি গায়। আর সারা বছর ঘুরে বেড়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে।

এই প্রথম পহেলা বৈশাখের আয়োজনে গাইতে পারবে বলে উচ্ছসিত দলের শিল্পীরা। যাক কয়েক যুগ পরে তারা নিজের গান নিজের জন্য, নিজের এলাকার জন্য গাইবে এর চেয়ে আর ভালো কী হতে পারে! শিল্পীদের চেয়ে একটু বেশি উচ্ছসিত প্রবীন সংগীতানুরাগী ও সংস্কৃতির কিছু পৃষ্ঠপোষক। তারা এককালে এই আয়োজনগুলো দেখেছে রাত জেগে জেগে, পেয়েছে নির্মল আনন্দ। বর্ষবরণ উপলক্ষে এমন একটি আয়োজন নতুন প্রজন্মকে জেলার অতীত সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করাতে পারবে বলে তাদের এই উচ্ছাস।

অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে সাতদিন আগে মাইকিং শুরুর সাথে সাথেই বিপত্তিরও শুরু। প্রথমে আশপাশে থেকে কানাকানি হলো, বলাবলিও শুরু হলো। কুশান গানে কী হয়, কারা করে, কীভাবে পরিবেশন হয় এসব নানা প্রশ্ন জনে জনে। একজন- দুইজন করে তাদের দল ভারী হলো, আওয়াজও ভারী হলো। তারা দলবেঁধে প্রতিবাদ জানাতে গেল আয়োজকদের কাছে।

জানানো হলো, কুশান গান ও পালাগান হিন্দুদের গান, এই মাঠে গাইতে দেয়া হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ হলেও এই মাঠে ঈদের জামায়াত হয়, সে মাঠে ‘সীতার বনবাস’, ‘বেহলা লক্ষিন্দরের পালা’ হতে পারে না। আয়োজকরা অনুনয়-বিনয় করলেন, বললেন দাওয়াত পত্র ছাপিয়ে বিতরণ করা হয়ে গেছে, মাইকিং করা হয়েছে, গানের দলকে অগ্রিম দেয়া হয়েছে, তাই অন্য কিছু ভাবার আর সুযোগ নাই।

বাতিলের দাবিদাররা এবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলো! আয়োজকদের সাফ জানিয়ে দেয়া হলো অনুষ্ঠান বাতিল না হলে  মসজিদের জামায়াতে আয়োজকদের নেয়া হবে না। ঈদের জামায়াতও এই মাঠে পড়বে না কেউ। অবশেষে এমন রোষের কাছে হার মানতে হলো আয়োজককে। তিনি গানের দলের দলনেতাকে ডেকে পাঠালেন। মুসলমানদের ধর্মের কোনো কাহিনী নিয়ে পালা আছে কীনা জানতে। দলনেতা অপারগতা দেখালেন। এমন হিম্মত দেখানোর সাহস তার নাই।

মুসলাম ধর্মের কোনো ঘটনায় গান বাঁধার আগেই তার গর্দান কাটা হবে বলে জানালেন। পরে বাধ্য হয়ে গানের আয়োজন বন্ধ করতে হলো আয়োজককে।

এতেও ক্ষান্ত দিলো না প্রতিবাদকারীরা। তারা তর্জন-গর্জন করতেই থাকলো। এই আয়োজকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হলো, দেখে নেয়ার হুমকিও দেয়া হলো,  এসব আয়োজকদের নাছাড়-নাস্তিক ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। তারপরের পরিণাম এখনও ঘোষণার আতঙ্কে ক্রমাগত ঘনীভূতই হচ্ছে।

অথচ মাত্র দুই যুগ আগেও এই গ্রামে কোন বোরখা পরা অতিথি বেড়াতে এলে পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা প্রথমে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতো। পরে আবার লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো অদ্ভুত পোশাকটির ভেতর থেকে কী বেরিয়ে আসে। আজকাল এই গ্রামের ৮০ ভাগেরও বেশি নারী বোরখা পরে।

এমনকি হিন্দু নারীদেরও বোরখার আদলে কাপড় পরতে দেখি। হিন্দু নারীদের মধ্যে আর একটা বিষয় খেয়াল করি। যারা একসময় সিঁথিতে মোটা ও গাঢ় করে সিঁদুর পরতো, তারা ক্রমে খরচ কমিয়েছে সিঁদুরের। কেউ কেউ খুব চিকন করে ঘন চুলের ফাঁকে সামান্য টান দিয়ে রাখে, আর অনেকে এতোটাই হালকা করে দেয় যে দেখেই যেন কোন ধর্মের অনুসারী তা অনুমান করা না যায়।

বোরখা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিস্ময় লাগে যখন দেখি সেই সব নানী-দাদীদের যারা যৌবনে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরতেন, তাদের ক্ষয়ে যাওয়া ক্ষীণ দেহের হাড় বেঁকে গেছে, নড়বড়ে হাঁটুতে বল নেই, কোমরেও শক্তি নেই,  মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে কুঁজো হয়ে গেছে শরীর, সেই শরীর ঢাকতে হচ্ছে বোরখায়!

শুধু কি বোরখা? হাতে-পায়ে কালো মোজা। চোখেও কালো চশমা। না, কোন সানগ্লাস না, ছানি অপারেশনের পরে যে কালো চশমা পরতে হয়, তাই পরের এই প্রবীণ নারীরা। আর গৃহবধু থেকে কর্মজীবী, স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েদের এখন সবটুকু ফ্যাশনও বোরখা আর হিজাবে। এমনও দেখি কিছু কিছু মেয়ে শিশু মায়ের কোলেও বোরখা-হিজাবে ঢেকে আছে।

সামাজিক এই পরিবর্তনগুলোতে ক্রমেই ছেয়ে যাচ্ছে আমার এই গ্রাম। ঢেকে দিচ্ছে নিজের সংস্কৃতিকে ধর্মের লেবাসে। ক্রমবর্ধমান এই পরিবর্তন শুধু কি কৃষ্ণপুরের, নাকি পুরো দেশের!

তবে সমাজ যে চোখে ঠুলি পড়ে অন্ধকারের পথে চলছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে গহীনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, অতলে তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের মননশীলতা। আমাদের মনের দখল নিচ্ছে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ।

শেয়ার করুন:

ভাল, ওয়াজ মাহফিলে মাইকে করে অন্য ধর্মের শ্রাদ্ধ করা যাবে। আর যাত্রা-পালাগানে তো কেবল একটা কাহিনীর নাট্যায়ন হয় মাত্র, এতেই মুমিনদের অনুভূতি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। যাই হোক, ধর্মীয় অনুভূতি হল মুসলিমদের বাপের সম্পত্তি।

নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটা আলোচনা যোগ্য। কিন্তু যে পালা হবার কথা ছিলো সেটাও যে একটি ধর্মীয় পালা তা এড়িয়ে গেলেন সযতনে। আপনি বোধহয় পালকিসহ গঙ্গা-স্নানের ইতিহাসটা ভুলে গেছেন। কোন একটা বিষয়কে হেয় করে অন্য একটা বিষয়কে বড়ো করা যায়না।

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.