আফসানা বেগম: প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়াতে গিয়ে একদিন ছাত্রদের কাছে অপ্রাসঙ্গিকভাবে জানতে চাইলাম, ‘কতজন একটা উপন্যাস পড়েছেন?’ প্রায় নব্বই জন ছাত্র-ছাত্রীর ক্লাসে সাতটা হাত উঠলো।

‘দুটো উপন্যাস?’ পাঁচটা হাত টুপ করে নেমে গেল। ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘তিনটা?’ উঁচু করা হাতের অবর্তমানে দিন-দুনিয়ার চিন্তাবিহীন সাদা দৃষ্টিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম তখন।
গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, ইতিহাস? আর কিছু জানতে চাইতে সাহস হলো না।
মানতে ইচ্ছে না হলেও এটাই সত্য যে ইতিহাস-সংস্কৃতি না জেনেই চোখের সামনে কেবল হাতে-পায়ে বড়ো হয়ে উঠেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। একটা নিম্নবিত্ত পরিবারে যেমন শিশুকে সামান্য খাইয়ে-পরিয়ে একটু বড়ো করার পরে তার সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটানোর তেমন কোনো উপায় বাবা-মায়ের হাতে থাকে না, তারা নির্ভর করেন স্কুল বা মাদ্রাসার উপরে, অনেক ক্ষেত্রে তাও না, কেবলই পরিবেশ থেকে পাওয়া শিক্ষা শিশুটিকে বড়ো করতে থাকে।
কষ্টকর হলেও সত্য যে আজ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারেও একই অবস্থা। নিজেদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুকে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দেয়ার পরে তারা বেশ নিশ্চিন্ত। তারপর নিজেদের জীবনের সংগ্রাম আছে, মুক্ত বাজার অর্থনীতির সঙ্গে দ্রুত লয়ে দৌড়ানো আছে, তার মধ্যে নিজেদের জন্য আনন্দ খোঁজারও ব্যাপার আছে।
যাদের ছোটোকাল থেকে দেখেছি সুযোগের অভাবে পড়তে পারেনি বা জানতে পারেনি, তাদের জন্য যে দীর্ঘশ্বাস বরাবর এসেছে, তা ভিন্ন। নিজের অবস্থানে থেকে যতটুকু পারা যায় সহায়তা করার চেয়ে বেশি কিছু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা করি না।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি তা থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করেও তেমন সফল হইনি। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য কখনো এটাই ভেবেছি যে ছোট্টবেলায় সুকুমার-উপেন্দ্রকিশোর কিংবা একটু বড়ো হতেই রবীন্দ্রনাথ-মানিক হাতে তুলে না দিলে আমারো হয়ত সাহিত্য পড়া হতো না। ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দিনের পর দিন বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করে দেখেছি, কোনো বিষয়ের গভীরে যাবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাদের নেই, সামান্য কিছু বিষয় ভাসা ভাসা জানলেই তারা তৃপ্ত।
যে করেই হোক, জীবন তো চলে যায়, সব ঠিকঠাকমতোই চলতে থাকে, এই পরিতৃপ্তি তাদের বড়ো সম্পদ, যার কারণে নিজের গণ্ডির বাইরের বিশাল পৃথিবীকে তারা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে। কিছু বলতে গেলে মনে হয়েছে, একটা কচি ডালকে বাঁকানো যত সহজ, নিজের মতো করে জায়গা করে নেয়া বৃক্ষকে বাঁকানো আর তত সহজ নয়। অথচ কেন যেন তাদের উপরে দোষ দিতে মন সায় দেয়নি।
বরাবর ভালো লাগে যখন দেখি আর যাই হোক আমাদের পরের প্রজন্ম মুখ ফুটে অনেক কিছু বলতে শিখেছে, আমাদের চিরায়ত ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ ধারণা থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজের ক্লাসের ছাত্রীকে করিডরে দাঁড়িয়ে যখন ফোনে মায়ের সঙ্গে চেঁচিয়ে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করতে দেখেছি, মন খারাপ হয়েছে।
আবার কষ্ট হয়েছে যখন বাবা-মায়ের মধ্যে সদ্য বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে এমন এক নেশাগ্রস্ত ছাত্র মধ্যরাতে ফোন করে বলেছিল, ‘ম্যাম, আব্বু বা আম্মু কেউই আমাকে তাদের বাসায় ঢুকতে দিচ্ছে না, আমি এখন কোথায় যাবো?’
আমাদের প্রজন্মে সামাজিক অধিকারবোধ নিয়ে নতুন জাগরণ এলো। মানসিকভাবে বা বাস্তবে আমরা সাজানো নিয়মের জালে আর ততটা বন্দী থাকিনি যতটা আমাদের আগের প্রজন্ম ছিল। কেউ জীবন ধারণ করতে দিনরাত খাটছি, কেউ বা জীবনের আনন্দলাভের জন্য সারাদিন ব্যয় করছি, এর মাঝখানে আমরা নিজেরাই কোনো বড়ো শূন্যতার জন্ম কি দেইনি? অর্থনৈতিক উন্নতি যে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে কত সমস্যা আমাদেরই জীবনে যোগ করেছে, তা তো আমাদের একেবারে অজানা নয়!
কদিন আগে টেলিভিশনে দেখলাম, ঢাকার এক নামী স্কুলের শিক্ষিকা, যার নিজেরই সন্তান সেই স্কুলের ক্লাস ওয়ানের ছাত্র, ক্লাসে তিনি লিখতে বলেছিলেন বড়ো হয়ে কে কী হতে চায়। বাড়ি ফিরে খাতা দেখতে গিয়ে দেখলেন তার নিজের ছেলে লিখেছে যে বড়ো হয়ে সে হয় টেলিভিশন, নয়তো মোবাইল ফোন হতে চায়। কারণ স্কুল থেকে ফেরার পর থেকেই সে বাবাকে ফোনে আর মাকে টেলিভিশনে ব্যস্ত থাকতে দেখে।
এখন কেউ যদি বলেন যা ঘটলো তা খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল, তা হবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করার ইচ্ছা কিংবা বোকার স্বর্গে বাস করার আগ্রহপ্রসূত। নব্বই দশকের শুরু থেকে আমরা নিজেরাই কি নিজেদের জন্য এই গর্ত খুড়িনি? আজ যখন নিজেদের সেই গর্তে পরার সময় হলো তখন এত বিস্ময়? আমাদের চোখের সামনেই কি আমরা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সামাজিক ধ্যানধারণা, পোশাক, সবকিছু বদলে ফেলিনি? নিজেদের মধ্যেই টুকরো টুকরো হয়ে যাইনি?
নিরাপত্তার আশায় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া পরিবারে দেখেছি, যে দেশে আছেন তার সংস্কৃতিকে একসময় অপসংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আর নিজের ফেলে আসা সংস্কৃতির অনুপস্থিতি যখন উঠতি বয়সের সন্তানের মধ্যে তীব্র তখন তাকে সাধারণ স্কুল থেকে উঠিয়ে নিয়ে ধর্মীয় স্কুলে দিয়ে দিয়েছেন। তারপর সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছেন ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে কিংবা পলায়নপর মনোভাব থেকেই আর খোঁজ নেননি তাদের। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সন্তানটিকে পুরোপরি বদলে যেতে দেখেছেন, সেই পরিবর্তন বাবা-মাকে খুশি করতে পারেনি অনেক ক্ষেত্রেই। নিজেদের সুবিধার জন্য নিজের সংস্কৃতিতে বাচ্চাকে ফেরানোর জন্য তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। আজ আমাদের নিজেদের মাটিতেও কি আমরা তা কম করছি?
আমাদের ধর্ম ছিল ধর্মের জায়গায়, একান্তে। অথচ আজ পরিবার থেকে শুরু করে জঙ্গিবাদ, সমস্ত কিছুতে ধর্মের ব্যবহার। আমরা আগে নিজেদের সন্তানদের মানসিকতা গড়ার সমস্ত দায়িত্ব নিজে নিতাম, এখন চাই প্রত্যক্ষভাবে স্কুল আর পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র তার দেখাশোনা করুক। আর আমাদের দুর্ভাগ্য, যে রাষ্ট্রে একজন তরুণকে কেস শেষ করার উদ্দেশ্যে তথাকথিত ক্রসফায়ারের দিকে ঠেলে দেয়া হয়, তার কাছেই আমরা অন্য কোনো তরুণকে রক্ষার আবেদন জানাই।
আমাদের তরুণেরা হারিয়ে যায়, অনেক সময় তাদের খোঁজে পুলিশের সাহায্য চাইতেও আমরা ভয় পাই। এদিকে আমাদের দিন যায় ‘আই এস আছে, আই এস নেই’ এই গবেষণায়, এই ফাঁকে ধীরে ধীরে আমাদের তরুণেরা আরো অচেনা হয়ে যায়, রাষ্ট্র আর তার কল্পিত বিরোধীদল নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আমাদের বিচারহীনতা আর ভয়ের সংস্কৃতি আমাদেরই সাথে সাথে ছায়ার মতো হাঁটে। কিন্তু কান্নাকাটি আর আবেগ বা ঘৃণায় ডুবে আর কতদিন পার করবো আমরা?
দুদিন আগেও গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী অতি আবেগে উচ্চারণ করছিলেন, ‘দিস ইজ নট বাংলাদেশ। ইট ইজ অন্যরকম।’ আসুন এসব আবেগ-টাবেগ বাদ দেই, এই অবস্থায় এসে দাঁড়ানোর পেছনে যতগুলো কারণ থাকতে পারে তার অন্তত একটি নিয়ে নিজের অবস্থানে থেকেই কাজ করি, পারিবারিক আর সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করি, অ্যাপার্টমেন্টে থাকি বলে যেন ‘অ্যাপার্ট’ হয়ে না যাই, নিজের সন্তান কিংবা নিজের আশেপাশে থাকা অন্তত একজন বা দুজন মানুষকে জঙ্গিবাদ আর মানবতাবাদের পার্থক্য বোঝাই।
আমাদের ছোটো ছোটো প্রচেষ্টায় একটু একটু করে অন্ধকার দূর হোক।
Not only for the present devastating national-social cause – it’s require for all of us in general, and for any individual or personal cause in particular for healthy family, society thereby nation.
I’m not sure but optimistic that the Nation will not only overcome this situation – there shall also be better social bondage with healthy colorful fabrics