ছাপোষা মানুষের দায়ভার

শাশ্বতী বিপ্লব: আমাদের মতো চাকরিজীবী ছাপোষা নিরীহ মানুষের অবস্থা যেন অনেকটা বাইলেটারাল অর্গানাইজেশনে কাজ করা দেশীয় কর্মচারীর মতো। কাজ করে, শ্রম দেয় কিন্তু ঠিক “ওওন” করে না। অর্গানাইজেশনের পলিসি বা স্ট্র্যাটেজি তৈরিতে দেশীয় কর্মচারীদের তেমন কোন দায় থাকে না।

হ্যাঁ, প্রাথমিক আলোচনায় দেশীয়দের অংশ নেয়ার সুযোগ থাকে বটে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত একান্ত তাদের। কোন পলিসি মনমতো না হলে বা অর্গানািজেশনের কোন সিদ্ধান্তের কারণে বিব্রত হলে সান্ত্বনা একটাই, এর দায় আমার নয়, আমি বেতনভোগী কর্মচারী মাত্র।

Shaswati 5দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়েও আমাদের কারো কারো মনোভাব একইরকম। আমরা প্রশ্ন করছি, “আমরা কি এই দেশ চেয়েছিলাম?”

– কাকে প্রশ্ন করছি? কে উত্তর দেবে এই প্রশ্নের? বা কবিতার লাইন ধার করে বলছি, “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়”। এই দেশ তবে কার?

এই দেশ তো আমার দেশ, আপনার দেশ, আমাদের দেশ। এই জঙ্গিরা আমাদেরই সন্তান। শুধু জঙ্গি কেন, আমাদের দেশের যা কিছু ভুল, ব্যর্থতা বা ক্ষত সব কিছুতে আমাদের দায় আছে। আমরা চেয়েছি বলেই দেশটা আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমরাই দায়ী, এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে। অস্বীকার করতে চান, করুন। শুধু মনে রাখবেন, দায় স্বীকার না করা এবং গা বাঁচিয়ে চলার সংস্কৃতিই আজ দেশটাকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

যতবার কোন অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারিনি, দলীয় কারণে বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বা অন্য কোন স্বার্থের কারণে সমর্থন করেছি বা নীরব থেকেছি, ততবার অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছি।

যতবার কোন অপরাধকে সরাসরি সমর্থন না করেও “যদি”, “কিন্তু” “তবে”র বাতাবরনে তাকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছি ততবার আমি অপরাধ করেছি।

যতবার পরের বিপদে চুপ থেকেছি, ততবার নিজের বিপদ ডেকে এনেছি। যতবার বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়াইনি, ততবার নিজের পাশ থেকে মানুষ হারিয়েছি।

যতবার অন্ধস্নেহে সন্তানের অন্যায় আচরণের সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছি, ততবার তাকে অন্যায় করতে উৎসাহিত করেছি, লজ্জিত হতে নয়।

যতবার তাকে পুঁথি মুখস্ত করা তোতা পাখী বানাতে চেয়েছি, ততবার তার মনের জানালা বন্ধ করে দিয়েছি।

যতবার তার ইংরেজী বা আরবী জ্ঞান নিয়ে গর্বিত হয়েছি, কিন্তু বাংলা জ্ঞানের স্বল্পতা নিয়ে শংকিত হইনি, ততবার তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছি নিজ দেশ থেকে, নিজ সংস্কৃতি থেকে। ততবার তাকে উন্নাসিক হতে শিখিয়েছি।

যতবার অন্য ধর্মকে অসম্মান করেছি, ততবার নিজের ধর্মের জন্য অসম্মান কিনেছি। যতবার তাদের ঘৃণা করেছি, ততবার নিজের ঝুলিতেও ঘৃণা জমা হয়েছে।

যতবার দুর্বলের উপর ক্ষমতা দেখিয়েছি, ততবার নিজের পায়ের নিচের মাটি দুর্বল হয়েছে। কথায় আছে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমাদেরই বা ছাড়বে কেন?

Gulshan 11আমার সন্তান মানুষে মানুষে বিভেদ করতে শিখেছে আমাকে দেখে। মানুষকে ঘৃণা করতে শিখেছে আমাকে দেখে। দেশকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে শিখেছে আমাকে দেখে। পাকিস্তানকে ভালোবাসতে শিখেছে আমাকে দেখে। হিন্দি সিনেমায় নিমজ্জিত হয়েছে আমাকে দেখে। রবীন্দ্রনাথকে ঘৃণা করতে শিখেছে আমাকে দেখে। মিথ্যা বলতে শিখেছে আমাকে দেখে। নিজেকে সুপিরিয়র/ ইনফিরিয়র ভাবতে শিখেছে আমাকে দেখে।

তার জীবন দেখার মূল দৃষ্টিভঙ্গী আমার তৈরি করে দেয়া।  হ্যাঁ, আমিই দায়ী, সচেতন বা অসচেতনভাবে।

যতবার শুধুমাত্র নিজের জীবন নিরাপদ করতে চেয়েছি, একা ভালো থাকতে চেয়েছি, ততবার অন্যায় করেছি। যোগ্যরা জায়গা ছেড়ে দাড়িয়েছে বলেই, অযোগ্যরা সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। সেই দায়ভার যোগ্যদের নিতে হবে বৈকি।

আমি শিক্ষক হিসেবে “দায়িত্ব” পালন করিনি, রাজনীতিবিদ হিসেবে “দায়িত্ব” পালন করিনি, আইনজীবী হিসেবে “দায়িত্ব” পালন করিনি, চিকিৎসক হিসেবে “দায়িত্ব” পালন করিনি, সংবাদকর্মী হিসেবে “দায়িত্ব” পালন করিনি, ব্যবসায়ী হিসেবে “দায়িত্ব” পালন করিনি। প্রতিবেশি হিসেবে নয়, সন্তান হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে নয়, আত্মীয় হিসেবে নয়। যা করেছি সেটা শুধু নিজের একার আখের গোছানোর চেষ্টা। হয় নিজে অন্যায় করেছি, নয়তো অন্যায়কে পাশ কাটিয়ে গিয়েছি। দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।

আমাদের সন্তানদের জঙ্গি বানাতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তার অনেকটা যোগান দেই আমরাই। তাদের ব্যাংকে টাকা রেখে, তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে, তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তান পড়িয়ে, তাদের বাস সার্ভিসে ট্রাভেল করে, তাদের রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে….এমনি আরো অসংখ্য উপায়ে। এগুলো বর্জন করার ডাক পেয়েছি অনেকবার, শুনিনিতো।

আজ আমাদের সন্তানদের বর্বর বানাতে যখন সেই অর্থ ব্যয় করা হয় তখন আমরা কাকে দায়ী করবো খুঁজে বেড়াই!!! সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র আমরা!!!

জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা বুঝি শুধু সরকারের- আপনার-আমার নেই?

সন্তানকে লাইনে রাখার দায় কেবল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর – আমার-আপনার নয়?

সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, আপনার-আমারও নয়?

সৎ থাকার দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের, আপনার-আমার নয়?

মানবিক হওয়ার দায়িত্ব কেবল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর, আপনার-আমার নয়?

সুস্থ্য বিনোদনের দায়িত্ব কেবল মিডিয়ার, আমার-আপনার নয়?

দায় নেই বললেই কি দায় এড়ানো যায়!!!

বাংলাদেশের মতো গরীব দেশে এতো উচ্চমূল্যের শিক্ষা ব্যবস্থা কিভাবে চলে? এতো বিপনীবিতান কিভাবে ক্রেতা পায়? এতো দামী গাড়ি কেন রাস্তায়? এতো দামী দামী রেস্টুরেন্টে উপচে পরা ভীড় কেন? কোথা থেকে আসে এতো অর্থ, বিত্ত? আমাদের সবার পূর্বপুরুষতো জমিদার বা নবাব নয়, তবে?

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি মাপে। আমি বলি, প্রতিষ্ঠানের নয়, মানুষের দুর্নীতি মাপুন। প্রতিষ্ঠান মানুষ চালায়, রাজনীতি মানুষ চালায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানুষ চালায়, ব্যবসা মানুষ চালায়, খাবারে ভেজাল মানুষ দেয়। চিকিৎসার নামে, শিক্ষার নামে, রাজনীতির নামে মানুষ ব্যবসা করে। আর এই মানুষগুলো আমরাই। সরকার ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা, শিক্ষক, চিকিৎসক, পুলিশ, আমলা, সাংবাদিক বা অন্য পেশাজীবীরাতো অন্যদেশ থেকে আসে নাই। আমরাই এই পেশাজীবীর দল।

নিজেরা সারাদিন যা করি তাতে কত ভাগ দুর্নীতি, কত ভাগ স্বজনপ্রীতি, কত ভাগ মিথ্যা কথা, কতভাগ ফাঁকিবাজী, কতভাগ মতলববাজী থাকে একটু হিসাব করে দেখেছি কি? আমরাই দুর্নীতিবাজ, অসৎ, স্বার্থপর,  লোভী – প্রত্যেকে, যার যার জায়গা থেকে। নই? বুকে হাত রেখে বলুন। বিন্দু বিন্দুতেই সিন্ধু হয় নাকি?

আমাদের উদাসীনতা, সুবিধাবাদীতা, স্বার্থপরতা, কূপমণ্ডুকতা, দলীয় দাসত্ব, নিরবতা – সবকিছুর মাশুল গুনছি আমরা।

আত্মসমালোচনা এখন সময়ের দাবী। আসুন নিজের দিকে আঙ্গুল তুলি। অন্যকে দোষারোপ না করে নিজের দায় স্বীকার করি। আসুন সবাই মিলে ভালো হয়ে যাই। অনেক সমস্যার এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন।

শেয়ার করুন: