জান্নাত শাহী: আমরা যারা নিজেদেরকে কারো না কারো বন্ধু বলে দাবি করি, হলফ করে বলতে পারি ফারাজের মতো খুব কম বন্ধুই পাবো বা হতে পারবো। গুলশান ট্রাজেডির ভয়ংকর প্রাণবিধ্বংসী সেই রাতে ফারাজ ঠিকই প্রাণ নিয়ে মায়ের কোলে ফিরে আসার দুর্লভ সুযোগ পেয়েও সে তার অপর দুই বন্ধু অবিন্তা কবির আর তারিশি জৈনকে মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে একা ফেলে আসতে পারেনি! বরং অনুরোধ করেছিল তাদেরকেও তার সাথে ছেড়ে দেয়ার জন্যে।
প্রশ্ন হলো, আমি যদি সেই জায়গায় থাকতাম বন্ধুর জন্য কি এমন আত্মত্যাগ করতে পারতাম? হয়তো বা পারতাম না! জীবনের মায়া যে বড় স্বার্থান্বেষী মায়া! আপন অস্তিত্ব যখন তীব্র সংকটে তখন পেছন ফিরে তাকানোর সাহস কয়জনের আছে!
হামলাকারীরা ফারাজের প্রায় সমবয়সী বা তার থেকে বড়জোর দুয়েক বছরের ব্যবধানে ছোট-বড় ছিল। একদিকে একজন ফারাজ যেখানে দুটি জীবনের আশায় নিশ্চিত মৃত্যুর আশংকা জেনেও ফিরে আসার সুযোগ প্রত্যাহার করে ওখানে অবস্থান করেছিল, অপরদিকে ছয়জন তরুণ অবলীলায় হিজাব-কালিমা আর রিলিজিয়াস আইডেন্টিটিরর দোহাই দিয়ে বিশটা উজ্জ্বল, প্রাণোচ্ছল নিরীহ মেধাবী প্রাণকে একরাত্রির ব্যবধানে বিলীন করে ফেললো।
কী বিভৎস!! কী নির্মম!! অথচ এই ছয়টা ছেলেও হয়তো কারো না কারো বন্ধু ছিলো। মানুষের মনোজগতের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন আমরা সহজে অনুমান করতে পারি না বলে কিংবা আমরা দেখেও না দেখার ভান করি, বোঝেও না বোঝার ভান করি বলেই এত্তো বন্ধু, আত্মীয় পরিজন এতো ভিড়ের মাঝে থেকেও ধীরে ধীরে এই সেল্ফি যুগের শিক্ষিত ছেলেগুলোর আমজনতা থেকে খলনায়ক হয়ে ওঠা।
একই সময়ে আরেক অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে ফারাজ বিপদের সময়ে, কঠোরতম সংকটের সময়ে তার বন্ধুদের প্রতি যে সহানুভূতি,আস্থা আর নির্ভরতার মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো তার নামই সত্যিকার বন্ধুত্ব। একসাথে খেতে গিয়েছিল একসাথে ফিরবে বলেই। তারা তিনজনের সর্বশেষ আই কন্ট্যাক্টটা কেমন দরদভরা ছিল তা কল্পনা করলেই এক প্রচণ্ড খারাপ লাগা কাজ করে মনে!
কর্পোরেট বন্ধুত্ব আর ভোগবাদী এই যুগে ফ্রেন্ডশিপ ডে’তে একখানা লাল-নীল-বেগুনি ফ্রেন্ডস ব্রেসলেট পরিয়ে দিলেই যেমন বন্ধু হওয়া যায় না, তেমনি ফেবুতে সেকেন্ডের মধ্যে লগ ইন করে মিনিটখানিকের মধ্যে ফ্রেন্ডস লিস্টে পাঁচ হাজার ফ্রেন্ডস থাকা সত্ত্বেও হাত বাড়ালে মন খোলে কথা বলার মতো পাঁচজন বন্ধু মিলবে কিনা ভাবনার বিষয়।
বলতে দ্বিধা নেই এমন বন্ধুত্ব আজকের অস্থির সময়ে সামাজিক জরাগ্রস্ততারই প্রতীকী আভাস মাত্র। এই প্যারালাইজড বন্ধুত্বের ফলাফল সমসাময়িক সময়ে ঘটে যাওয়া প্রায় প্রত্যেকটা অসঙ্গতির সাথে প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে জড়িত। মাঝে মাঝে একজন ভাল বন্ধু অভিভাবকের মত কাজ করে। নিবরাস বা আর যারা হামলাকারী ছিল তাদের কি এমন একজন বন্ধুও থাকতে পারতো না, যে তার কপালের ভাঁজে চিন্তালোকের ছায়াটা ধরতে পারতো! অবলীলায় বলতে পারতো, “বন্ধু কী খবর,কেমন আছিস বল?”
হোক না সে শৈশবের প্রথম স্কুলের প্রথম ক্লাসের প্রথম বন্ধুটি! হোক না সে বৃষ্টিতে ভিজে সারাদিন মাঠে ফুটবল খেলার সেই সঙ্গীটি! হোক না সে বিশ্ববিদ্যালয়ের টং দোকানে বসে থাকা আড্ডাবাজ চা’খোর বন্ধুটি!
কিংবা হোক না সে গভীর রাতের পাড়ার অলিগলিতে কারণে-অকারণে চষে বেড়ানো চাঁদ-তারা আর জোছনা দেখার সেই সুজন বন্ধুটি!
নিবরাস! ঘৃণা নয় তোমাদের তীব্র করুণা! আমি নিশ্চিত, তোমাদের যদি কোনো বন্ধু দুর্ভাগ্যক্রমে ওইদিন হলি আর্টিজানে থাকতো তোমরা তাদেরও প্রাণ নিতে কুণ্ঠাবোধ করতে না! তোমাদের দোষ দেই না। দোষ তোমাদের “মগজের” আর “ধোলাইকারীর”!!
অনুমান নয়, আস্থা থেকেই বলছি, তোমাদের আজকের এই পরিণতির পেছনে অন্যসব উপাদানের পাশাপাশি কথিত কোনো “বন্ধু”রই হাত ছিল। যে বন্ধু জীবন নিতে শেখায় সে কসাই ছাড়া আর কিছু নয়। সত্যিকার বন্ধু হতে গেলে,প্রবল দু:খেও কারো শুভাশিস কামনা করতে দম লাগে! সেই দম সবার থাকে না!
ফারাজ আয়ান হোসেন, তুমি আমার চোখে সুপার হিরো হয়ে বেঁচে থাকবে!!