চৈতী আহমেদ: শেষ হয়ে গেলো ঈদুল ফিতর, যে কয়জনের সাথে কথা হয়েছে জিজ্ঞেস করেছি -কেমন আছেন? প্রত্যেকেই বলেছে -আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আমার মনে হলো হায় হায় আমি কেমনে কেমনে সব পবিত্র আয়াত পেছনে ফেলে এতো আগে চলে আসলাম! আমার তো কিছুই মনে নাই, সুরা ফাতেহা পড়তে গিয়ে দেখি ‘মালিকি ইয়াও মিদ্দিন.. এরপর আর যাইতে পারতেছি না।
অথচ ৯/১০ বছর বয়সে আমার বিশ-পঁচিশটা সুরা মুখস্ত ছিলো, তাড়াতাড়ি মুখস্ত হতো বলে আম্মা স্বপ্ন দেখেছিলো আমাকে হাফেজ বানাবে। সেই সময় আমি দেখতাম আম্মার চোখে চকচক করতো বেহেস্তের লোভ। একই লোভে আম্মাকে দেখেছি জীবনে কোনোদিন আব্বার কথার অবাধ্য হয় নাই। খুব বিশ্বাস করতো স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেস্ত। যার কারণে আমি আম্মাকে সেইভাবে কোনোদিন ভালোবাসতে পারিনি, হয়তো আম্মাও আমাকে।
আম্মা সব সময় চাইতো আমাকে কোনো আরবি জানা বাঙাল মুলুক থেকে সৌদি আরবে হিযরত করা কারো সাথে বিয়ে দেবে। কিন্তু আমি তো জীবনেও কালো বোরখায় আমার নাক-মুখ ঢেকে চলাকে মেনে নিতে পারিনি।
গ্রামে কম যাওয়া হতো আমাদের, কখনও গেলে আমি এলো চুলে পাহাড়ে, নাফ নদীর পাড়ে চলে যেতাম, স্বজনরা আম্মাকে বলতো, তোমার মেয়ে যে বড় হইছে চোখে দেখো না? মেয়ে দিনে দুপুরে পাহাড়ে নদীর তীরে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ায়। নির্ঘাত কোনো খারাপ জিনে আছর করেছে, আম্মা সৌদি আরবে তার ভাইপোদের কাছে অর্ডার করে আমার জন্য খুব সুন্দর বেগুনি প্রজাপতি এপ্লিক করা বোরখা আনালো। সেই বোরখা আমি কাচি দিয়ে কেটে ফ্রক এর মতো বানিয়ে নিলাম, তাই পরে ঘুরতে লাগলাম।
এই অপরাধে সেই ১৩/১৪ বছরের আমাকে মামারা দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে তিন দিন খাটের উপর ফেলে রাখলো। মা চড়িয়ে আমার দাঁত নড়বড়ে করে দিলো। এর সবই ঘটলো আমার আব্বার অগোচরে। আব্বার কাছে খবর গেলো, আব্বা এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলো।
সেই আমার জন্মভূমি থেকে প্রথম নির্বাসন, লেখা আছে অশ্রুজলে। আব্বাকে সতর্ক করে দেয়া হলো বেপর্দা মেয়েকে যেন আর গ্রামে না আনা হয়। আমাদের মানসম্মান আছে। বহু বছর আমি আর আব্বাকে ছাড়া দেশে যাইনি। যতবার গেছি আব্বাকে নিয়ে গেছি, এবং বোরখা পড়িনি। তারপর বড় হয়ে আমি আর আব্বা, আমাদের গ্রামে একটা স্কুল করার পরিকল্পনা করলাম। যাতে বোরখার মতো অন্ধকার থেকে গ্রামের মানুষকে মুক্ত করা যায় শিক্ষার আলো দিয়ে।
আমরা তখন থাকতাম উত্তর বাংলায়, সেখানেও আমার আত্মীয়রা উড়ে গিয়ে আমাকে আর আব্বাকে নসিহত করে আসতো। আব্বা কতখানি মুক্তমনের ছিলেন আমি জানি না, তবে আব্বা আমার করুণ মুখের দিকে চেয়ে সারা দুনিয়ার সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়তেন। তো সেই উত্তরবঙ্গ থেকে আমি আর আব্বা গ্রামে গিয়ে গ্রামে স্কুল করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি স্কুল করবো, আব্বা জমিসহ সব সাপোর্ট দেবে, স্কুল করা হলো, উপরে টিন বাঁশের বেড়া দিয়ে, গ্রামের কিছু আমার ন্যাওটা চাচাতো ভাই, যারা অল্প বিস্তর লেখাপড়া করার পর, একহাতে টেপ রেকর্ডার ঝুলিয়ে তাতে রোমান্টিক সব আঞ্চলিক গান বাজিয়ে অন্য হাতে লুঙ্গির খুট ধরে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতো অন্দরবাসিনী উঠতি কিশোরীদের মন পাওয়ার আশায়, সেই তারাই আমার কথায় রাজি হলো আমার স্কুলটিতে নাম মাত্র সম্মানীর বিনিময়ে গ্রামের বাচ্চাদেরকে পাঠ দান করতে।
আমি বেপর্দা হয়ে চলি বলে পাঁচ ছয়জন আমাদের বর্গা চাষাদের ছেলেমেয়ে ছাড়া খুব ছাত্র পাওয়া গেলো না, আব্বা বললো- হবে, আস্তে আস্তে হবে। দিনক্ষণ ঠিক হলো আব্বাকে দিয়েই স্কুল উদ্বোধন করা হবে, যথাদিনে যথা সময়ে আমরা স্কুলে রওনা হলাম, স্কুল আর খুঁজে পাই না, আব্বা নিজের জমি বলে যেটা চিহ্নিত করলো, আমি সেখানে আর আমার স্কুল খুঁজে পাই না, চালের টিন বাঁশের বেড়া রাতারাতি সব গায়েব। স্কুল হলো না।
২০০২ সালে আব্বা মারা গেলো, আব্বাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে করে, আমরা রওনা দিলাম ঢাকা থেকে গ্রামের উদ্দেশ্যে, এতো কিছুর পরেও আব্বার গ্রাম আব্বার খুব প্রিয় ছিলো। সেই গ্রামেই দাফন হবে এমন ইচ্ছাই আব্বা জানিয়েছিলো। সারা রাত জার্নি করে আব্বাকে নিয়ে আমরা সকাল ৯টার দিকে গ্রামে পৌঁছালাম, সেই রাতে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি আব্বাকে বহনকারী এম্বুলেন্সের সাথে উড়ে উড়ে আমাদের গ্রাম অবধি এসেছিলো। একসাথে এতো জোনাকি আমি আর কখনও দেখিনি।
আব্বা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ২ নং সেক্টরের উপ সহ-অধিনায়ক ছিলেন তিনি, তারপরও মৃত্যুর আগে আব্বা নিষেধ করে বলেছিলেন, তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান চান না। আমরা যেন তার মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসনের কাছে সম্মানের জন্য ধর্না না দেই। প্রায় বলতেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলে, গোলাম আযমের ফাঁসি হলে, সেটাই হবে জীবিত বা মৃত সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি বিরল সম্মান।
আব্বা কোনো যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দেখে যেতে পারেনি। বিকেল চারটার দিকে আব্বার দাফন সম্পন্ন হলো, আমি একাই পাঁচটার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে গাড়িতে চড়ে বসলাম। তারপর আজ অবধি একবারও আমি স্বাভাবিক কোনো কারণে গ্রামমুখো হইনি।
এরপর যদিও দু’য়েকবার গিয়েছি, তাও লুকিয়ে। আব্বা নিজে বিশ্বাসী ছিলেন কি ছিলেন না আমরা কোনোদিন বুঝতে পারিনি। আব্বা রোজা যদিও রাখতেন, নামাজ পড়তেন কদাচিত। আম্মার কান্নাকাটি অসহ্য হলে মাঝে মাঝে নামাজ পড়তেন। রোগা-পটকা ছিলাম বলেই কিনা জানি না, আম্মা সেহরির সময় সবাইকে লাঠিপেটা করে ডাইনিং টেবিলে বসাতেন ঠিকই, সকাল আট-নটা বাজলে আব্বা চুপি চুপি আমার কাছে এসে বলতেন, একটু পানি খেয়ে নে, রোজা ভাঙলে সকাল সকাল ভাঙতে হয়, রোজা পেকে গেলে গুনাহ বেশি হবে। আমিও মা ঘুম থেকে উঠার আগেই ঢকঢক করে কাঁচা রোজা ভেঙে ফেলতাম। তারপর একটু বেলা হলে চলে যেতাম খেলতে তুলসীরামের বাগানে, সেখানে পেয়ারা গাছে উঠে পেট ভরে পেয়ারা খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। অন্য ভাইবোনরাও চেপে যেতো তাদের পেয়ারা খাওয়ার কথা আম্মার কাছে।
বাড়িতে ইফতারের আয়োজন হতো ব্যাপকভাবে। আমরা সবাই মুখ শুকনো করে টেবিল ঘিরে বসে অশেষ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতাম। আব্বা তোকমা ও রূহ আফজার সরবত বানাতো আর মিটি মিটি হাসতো। এক্ষণে আমার কী সর্বনাশ হলো, আমার পবিত্র গ্রন্থের কিছুই মনে আসতেছে না। ইউটিউব করে সুরা ফাতিহা তো আয়ত্বে আনলাম, কিন্তু প্রয়োজনে ইহা আমার কোন কাজে আসবে বুঝলাম না।। কপালে লাল টিপ। টাইডাই এর উপর ব্লক মারা একটা ফতুয়া আর ইজ্জত ঢাকা যায় না এমন একটা ওড়না, সাথে সুরা ফাতিহা আর কালিমা পড়লে জাতে পতিত হওয়া যাবে না বেশ বুঝতেছি।
তাড়াতাড়ি ফোন লাগালাম আামার হিজাবি গোষ্ঠীর কাছে, শোলাকিয়ায় যুদ্ধ চলতেছে, ইসলাম কায়েম হইলো বলে, তাড়াতাড়ি আমার জন্য একটা বোরখা আর হিজাব বরাদ্দের আবেদন জানালাম। তারা বললো হাসানাত টাকলা আর তার হিজাবি বৌয়ের উপর রহমত বর্ষিত হোক, যে তোমারেও লাইনে নিয়ে আসছে। আমার মুখে খারাপ কথা এসে গিয়েছিলো, আপনা গোষ্ঠী তাই সেটা আর প্রকাশ করলাম না। তারা বললো হিজাব দিলেই তো হবে না, তোমার সেইগুলি পরতে হলে ট্রেনিং লাগবে।
ট্রেইনার এখন ঈদ লইয়া ব্যাপক ব্যস্ত। ঈদের পরে যোগাযোগ করো।
বললাম: ঈদ তো শেষ।
: না শেষ না, ঈদ চলে তিনদিন। ততদিন তুমি ঘরে বসে পাঁচ কালিমা আর যাহা যাহা ভুলিয়াছো তাহা অধিকার করো। আমি প্রমাদ গুণিলাম, আমার ঘরে যাহা যাহা আছে সবই অপবিত্র গ্রন্থ। আমার আর বাঁচিবার আশা নাই। তবু আমার একটা অদ্ভুত ভালোলাগা অনুভুত হলো। আমি অন্তত আমার মতো মরতে তো পারবো।
কপালে লাল টিপ, প্রিয়তর জিন্স, আর আমাকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়া টাইডাই করা ফতুয়া, মাথায় ছোটো ছোটো চুল। আহা বেশ বেশ। আমি কি ডরাই তলোয়ারে! শুধু অন্ধকারে আমি মরতে চাই না। আমি চাই মৃত্যুর সময় আমাকে ঘিরে থাক সূর্যালোক!
সম্পাদনা পরিষদ সদস্য, অনুপ্রাণন, শিল্প সাহিত্যের ত্রৈমাসিক
সালাম। লেখিকার জীবন অভিজ্ঞতার বর্ণনা যদি সত্যি এরকমটি হয়ে থাকে তাহলে দুঃখজনক। আরো অনেকেরই এরকম অভিজ্ঞতা হয়তো আছে। কিন্তু সেটাকে ঢালাওভাবে ধর্মের ওপরে চাপানোটা শুধু অবিচারই নয়, বরং সত্যের অপলাপ। কারণ তার মত একটি জীবনের সমান্তরালে শত-সহস্র জীবনের অভিজ্ঞতা এর বিপরীত। অনেক সময়েই ধর্মের নামে মানুষ অধর্ম করে। বুদ্ধিমতী-বিবেকবান ব্যক্তিরা সেখানে ধর্ম-অধর্মের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন, এটাই কাম্য। সেই সাথে এটাও স্বীকার্য যে ধর্মের নামে অনেক ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি আছে, সেগুলোর ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে, সেগুলো দূর করার চেষ্টা আমাদের করতে হবে। নিছক ধর্মকে টার্গেট করলে এসবের সমাধান নেই।
You have not understood anything in life. Not religion, nor yourself. You are a lost person in both spheres.