নারী শরীর-প্রেম নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলতা আর কতদিন?

ইমতিয়াজ মাহমুদ: এই যে মেয়েরা প্রশ্ন তুলছে রূপ জিনিসটা কি? এইটাও একটা কৌতূহল জাগানিয়া জরুরি প্রশ্ন। আমরা পুরুষরা তো নারীর শরীর দেখি, শরীরের গঠন আকৃতি রঙ ইত্যাদি। আমরা তো চাই যে নারীটি তার শরীরখানি আমাদের পছন্দমতো হালকা-পলকা করে রাখবে, আর সেটিকে নানাপ্রকার রঙ গয়না ইত্যাদি নানাপ্রকার ইয়ে দিয়ে ডেকোরেট করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করবে।

Imtiaz Bhai
ইমতিয়াজ মাহমুদ

জুতার ফ্যাক্টরি দেখেছেন? দেখেছেন সেখানে কিভাবে কাজ হয়? একেকটা জুতা নির্মাণের সময় এর রঙ আর অর্নামেন্ট নিয়ে বেশ ভাবনা চিন্তা করা হয়। এই দুইয়ের মধ্যে কি কোন মিল খুঁজে পান? জুতা তৈরি আর একটি নারীর রূপসজ্জা, ডায়েটিং ইত্যাদির মধ্যে? নাকি একটু বাড়াবাড়ি রকমের এনালজি টানছি?
একটু বাড়াবাড়ি রকমের হলেও এনালজিটা একদম উড়িয়ে দিতেও পারি না।
নারীকে হাজার বছর ধরেই আমরা আমরা আমাদের অস্থাবর সম্পত্তি বিবেচনা করি। কোন কোন ধর্ম দাবি করে যে নারীকে নাকি ওরা উচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। ওদের দাবির সপক্ষে ওদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনে দেখেবেন।

দেখবেন যে ওরা বলবে, আমাদের গ্রন্থে নারীকে মহা মুল্যবার হীরা জহরতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বটে? এই হচ্ছে সর্বোচ্চ মর্যাদা? আমার কন্যা আমার কাছে মহা মূল্যবান হীরক খণ্ড? ওরে গাধা, হীরক খণ্ড যতই মহা মূল্যবান হোক, সেও একটি হস্তান্তরযোগ্য সম্পদই বটে। আমার কন্যা আমার কাছে হীরক খণ্ড নয়- সেও একজন মানুষ মাত্র, মানুষ। ভাল-মন্দ-দোষ-গুণ-সুখ-দুঃখ সব কিছু মিলিয়ে একজন মানুষ- আমার মতোই মানুষ। আমার সম্পত্তি না।
গাধাগুলি সেই কথা বুঝবে কেন? ওদের কাছে বিস্ময়কর লাগে- মেয়েমানুষকে এইরকম মূল্যবান বলা হচ্ছে, এর পরেও এর কি চায়? ওদেরকে কি তবে পুরুষের মত মানুষ বলে বিবেচনা করতে হবে? বলে কি?

আপনি এদের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। বা পরিচিত নারীবাদীদের সম্পর্কে এইসব ধার্মিক লোকেরা যেসব নিন্দাবাক্য আর গালাগালি লেখে, সেগুলি পরে দেখতে পারেন। দেখবেন এইটা ওদের কথা। ওদের মুল প্রেমিস- যেটাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে ওরা আলোচনা করে- সেটা হচ্ছে নারী পুরুষের অধীনই থাকবে, পুরুষের সম্পদ। তবে আমরা কিনা সবচেয়ে ভাল ধর্ম, আমরা পুরুষের এই সম্পদটিকে অন্যদের চেয়ে বেশী মূল্য দিই।

আমি ওদেরকে বলতে চাই- সম্ভবত বেশীরভাগ নারীবাদীই এই কথাটিই বলে- যে, ভাইজান, নারীকে অত বেশী মূল্যবান বলার দরকার নাই। মেহেরবানী করে ফার্স্ট প্রেমিসটা পালটান। নারী যে একজন মানুষ এবং আপনার মতোই মানুষ এই কথাটা আগে মানেন। নারীর মূল্য নির্ধারণ করার দরকার নাই, নারী কোন পাত্থরের টুকরা না।

কিন্তু সে তো হবার নয়। শুধু ধর্মকে দোষ দিলে তো হবে না। আর ধর্মগুলি আনি যদি সঠিক কন্টেক্সটে তাইলে সেরকম খারাপ কিছুও না। একেকটা ধর্মের যখন আবির্ভাব হয়, আপনি যদি ঠিক সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় বিধানগুলি বিচার করেন তাইলে দেখবেন যা পূর্ববর্তী সামাজিক বিধানের তুলনায় এই বিধানগুলিই একেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল।

আজকের কন্টেক্সটে দেখলে গেলে একই বিধানকে অবশ্যই পশ্চাৎপদ মনে হবে। আর সমস্যাটা তৈরি হয়ও সেইখানেই, যখন কোন কোন গ্রুপ সেই সময়ের বিধানগুলিকে চিরন্তন এবং আজকের জন্যও প্রযোজ্য মনে করে।
এই জিনিসটাই আপনাকে জানতে হবে। সমাজ বিকাশের একটা পর্যায়ে যে ঘটনাটা একটা নতুন বিপ্লব বা বিকাশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, সেই ঘটনাই একসময় আমাদের উপর অপরিবর্তনীয় অলঙ্ঘনীয় বিধান হিসেবে চেপে বসে। এই যে চেপে বসলো এইটাকে যারা চূড়ান্ত বিকাশ মনে করে ওরাই প্রতিক্রিয়াশীল। প্রগতিশীল কেবল সেই, যে কিনা নতুন বিপ্লব চায়, সমাজকে বিকাশের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে চায়।

ধর্মগুলির মতো পুঁজিবাদের বিকাশও মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে অবশ্যই একটা বড় ইতিবাচক ঘটনা। বিপ্লবই বলতে পারেন। কিন্তু এইটাই চূড়ান্ত নয়। বিকাশের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সেটাই প্রগতি।
পুঁজিবাদও কিন্তু নারীকে এর আগের পর্যায় থেকে খানিকটা অগ্রসর করে এনেছে। নারীকে এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়েছে, তবেই নারীর ভোটাধিকার এসেছে। কাজের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সমান কাজে সমান মজুরি এটাও একটা মোটামুটি স্বীকৃত বিধান হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এইগুলি তো হচ্ছে অর্জনের দিক।
কিন্তু পুঁজিবাদেরও তীব্র সংকট আছে। পুঁজির মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পুঁজির কাছে সবকিছুই পণ্য। শ্রম মেধা রূপ যৌবন সবকিছুই পুঁজির কাছে পণ্য, যেটা নিয়ে ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন করতে হয়। পণ্য মানে কি? পণ্য মানে হচ্ছে যেটা কেনাবেচা করা যায়- চাহিদা আছে কিন্তু সরবরাহ সীমিত। আমরা টাকা দিয়ে যেসব জিনিস ভোগ করি সেগুলি তো পণ্য বটেই, সেই সাথে এইসব পণ্য তৈরিতে বা বেচাকেনাতে যেসব উপকরণ লাগে সেগুলিও পণ্য। এইসব উপকরণের মধ্যে শ্রমও আছে।
নারীকেও পুঁজি কেবলই একটু পণ্য হিসাবেই দেখে। কিভাবে? পুঁজি নারীকে দেখে পুরুষের ভোগের সামগ্রী হিসাবে। এজন্যে পুঁজি কায়দা করে নারী নামক এই পণ্যটির প্যাকেজিং আর প্রেজেন্টেশনের রূপ ডিফাইন করে।

এই যে আপনারা সাইজ জিরো, খোসা ছড়ানো ডিমের মতো নির্লোম মসৃণ ফর্সা ত্বক, চোখের রঙ, ঠোঁটের রঙ এইসব নানাকিছুকে রূপের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসাবে দেখেন, এইগুলি সবই পুঁজি ডিজাইন করে দিয়েছে। আর এই ডিজাইনকে মান ধরেই আমরা আমাদের শখের নারী পণ্যটিকে যাচাই বাছাই করি।
ধর্মের সাথে কি এর বিরোধ নেই? আছে। ধর্মগুলি নারীকে বিবেচনা করে একান্ত ভোগের সামগ্রী হিসাবে- মানুষের চেয়ে একটু নিম্নস্তরের জীব হিসাবে। আর পুঁজি নারীকে খানিকটা মানুষ বিবেচনা করে বটে- কিন্তু সেই পুরুষের জন্য ভোগের পাত্র মানুষ।

ঐ যে আগেই বলেছি, পুঁজিবাদও সমাজবিকাশের ধারায় একটা ইতিবাচক বিপ্লব হিসেবেই এসেছে। সামন্তবাদি সমাজে নারীরই রূপের ধারণা থেকে পুঁজিবাদে নারীর রূপের ধারণা এই যে খানিকটা পরিবর্তন সেই সেই ইতিবাচক পরিবর্তনের অংশ। এটা খানিকটা অগ্রসর হওয়া মাত্র, চূড়ান্ত গন্তব্য নয়।
এই যে নারী নামক পণ্যটি, সেই পণ্যটিকে বিক্রির জন্যে পুঁজি ব্যবহার করে শিল্প সাহিত্য রূপকথা সঙ্গীত এইসবের সবকিছুকেই। এমনকি ধর্মকেও।
ব্যাপারটা এমনভাবে কাজ করে যে এইগুলিই মনে হবে আপনার কাছে স্বাভাবিক সামাজিক আচরণ। দেখবেন একটি নারীশিশুকে আমরা গোলাপি রঙ দিয়ে রঞ্জিত করি। সে নিজেকে সিন্ডেরেলা, স্লিপিং বিউটি এদের মত করে তৈরি হতে থাকে। যেন নিজেকে একজন রাজকুমারের কাঁধে নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্যে তৈরি করা।

এবং এইটা আমাদের এই ঢাকা শহরেও প্রতিদিনের জীবনেও প্রত্যক্ষ করি। প্রেমের ক্ষেত্রেও দেখবেন নারীটি সবসময় আড়ষ্ট হয়ে থাকছে। কথা বলার সময় প্রতিটা কথা বলার আগে তিনবার করে ভাবছে- পুরুষটা না আবার কিছু মনে করে। এমনকি নারীটি যদি চাল্লু ধরনেরও বা প্রগলভাও হয়, তাঁকেও দেখবেন সে কেবলই ভাবছে পুরুষ বন্ধুটির মন রেখে কথা বলার।

প্রেমে যখন শারীরিক ব্যাপারগুলি আসে, তখনও দেখবেন নারীটি এবং পুরুষটি এমনভাবে কথা বলছে যেন কেবল পুরুষটিই এই শারীরিক মিলনটি উপভোগ করবে, আর নারী কেবল তাকে উপভোগ করতে ‘দিবে’।
পুরুষটি অনুনয় বিনয় করতে থাকে, ‘দাও’, এঁর নারীটি ভাবতে থাকে ‘দিবে’ ই দিবেনা। যেন মিলনটি মিলন নয়, দুইজনের সঙ্গম নয়, একজন আরেকজনকে খাচ্ছে মাত্র।
ভেবে দেখেন। তরুণ বন্ধুরা, আপনারা একটু গুছিয়ে, পড়ে, শুনে দেখে এইগুলি বিষয় একটু ভাবেন। ভাবতে তো হবে। প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে আর কতদিন থাকবেন। সমাজ পাল্টাতে হবে না?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.