ইশরাত জাহান ঊর্মি: বাবর রোডে ফ্ল্যাট বুকিং দেওয়া হয়েছে। সাব্বীর বলে, একটু একটু করে গায়ের রক্ত পানি করে টাকা আনছি ঊর্মি। চাকরিটা করে যেতেই হবে ফ্ল্যাটটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। আমরা একটু বড় বাসা চেয়েছি। একটা ছোটখাটো স্টাডি। সাব্বীর বলে, তোমার সাথে ঝগড়া হলে আমি ভাই স্টাডিতে যায়া ঘুমাবো। আর আমি ভাবি, যাকে আমি খুব ভালোবাসি গোপনে তারে একদিন বলবো, আমার বাড়ি আইসো বন্ধু বসতে দেবো পিঁড়ি…
কিন্তু ঘুম ভেঙেই আমার আলেপ্পোর কথা মনে পড়ে। সিরিয়া আর লিবিয়ার কথা। কত কত মানুষ কত কত স্বপ্ন নিয়ে জীবন সাজায়। বাগান সাজায়। ফুল ফোটাতে চায়। দু’তিনবছর আগেও কে জানতো সিরিয়ার মানুষদের এভাবে পালাতে হবে? নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে, প্রিয় প্রিয় বইগুলো আর বারান্দার টবের গাছগুলো ছেড়ে? মানুষ উদ্বাস্তু হবে কে জানতো? কে জানতো?
কাবুল ইউনিভার্সিটির একটা ছবি এখনও আমার চোখে লেগে আছে। স্কার্ট পড়া তিন শিক্ষার্থী হেঁটে যাচ্ছেন হাসতে হাসতে, গল্প করতে করতে। কী দ্বিধাহীন, অসংকোচ সেই হেঁটে যাওয়া। সেই কাবুল! সেই আফগানিস্তান!
আমি যখন এখন আমাদের মেয়েগুলোর দৃঢ় হেঁটে যাওয়া দেখি, তখন ঐ ছবিটার কথা শুধু মনে পড়ে। মাত্র কয়েক দশক আগেও ভাবা যেতো না, এতো হেরিটেজের দেশ ইরাক বা সিরিয়ার এই দশা হবে।
এই যে সেক্যুলার বাংলাদেশ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা, এই যে মধ্য আয়, এই যে সেহেরি পার্টি, এই যে পার্টিতে পার্টিতে রঙিন গেলাস, এই যে জারা আর শপার্স ওয়ার্ল্ড এ রাশি রাশি গাড়ির সারি-এসব ভেঙে ফেলতে, এসব ভেঙে পড়তে কতক্ষণ লাগে?
আর ঐ সবুজ ঘাসে পড়ে থাকা লাশগুলো! ওরা নাকি সিরিয়া গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল। তার আগে পোস্ট করা হাসিমুখের ছবি। রাতের মতো কালো পাঞ্জাবী পরা। গলায় রুমাল প্যাঁচানো।
আমি কি ভাবি জানেন, বাংলাদেশের মতো দেশে সবচেয়ে বড় দরকার হলো আ্যডাপ্টিবিলিটি। বড়লোক হওয়াটাও সহ্য করতে হয়। বড়লোক হতেও গ্রহণ করার মানসিকতা লাগে। শুধু ছেলেমেয়েকে ইংরেজি স্কুলে পড়ালেই, নিজে দামী জুতা পড়ে ওয়েস্টিন-রেডিসনে মিটিং করে বেড়ালেই, বউ পার্লারে গিয়ে বডি স্পা আর অল থ্রেডিং এর প্যাকেজ নিলেই, আত্মীয়-ভাই বন্ধু আজ নিউইয়র্ক, কাল ব্যাংকক করলেই অভিজাত হওয়া যায় কি?
নিজের মাটি থেকে রস না নিয়ে শুধু টাকা বানালে, নিজের মাটি থেকে ঘ্রাণ না নিয়ে শুধু সুযোগটুকু নিলে ঐ লাশগুলো পড়েই থাকবে বাংলার সবুজ ঘাসে। আমরাও লাশ হবো, ওরাও। আর বাংলাদেশ হয়ে উঠবে শেষতক মৃতভূমি।
পার্লারে যাই। মেয়েটা নরম আলতো করে চুলের মধ্যে হাত বোলায়। আমার কিছুই আরাম লাগে না। এক মহিলা এসে বসেন। সাধারণত: দুজন সেবা নিতে আসা মানুষ একে অপরের সাথে কথা বলে না। কেউ ফ্যাশন ম্যাগাজিনে চোখ বুলান, কেউ মোবাইল ফোনে। আজ কী হয়, ভদ্রমহিলা আমার সাথে কথা বলেন।
বলেন, জানেন আপা, আমার পরিচিত ছিল অবিন্তা মেয়েটা। ও কিন্তু সূরা টুরা পারতো, নার্ভাস হয়ে বলতে পারে নাই। আমি ঐ এলাকা খুব ভালোমতো চিনি। পাশেই যে লেকভিউ হাসপাতাল, ওখানে আমার দুটা বাচ্চা হয়েছে। ঐ রেস্টুরেন্টও আমার পরিচিত। খুবই এক্সপেনসিভ।
আমি একটু বিরক্ত হই মনে মনে। ভাবি ঐ সেই আলগা আভিজাত্য! কিন্তু এবার ভদ্রমহিলা যা বলেন আমি একটু চমকাই। একটু যেন আলোর রেখাও দেখতে পাই। মহিলা বলেন, দ্যাখেন আমরা ছোটবেলায় সাইকেল নিয়ে কোথায় কোথায় চলে গেছি, কোনদিন ভাবি নাই কেউ পেছনে আসতেছে। এখন আমি ভাবতে পারবো যে আমার মেয়ে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে? আর এই যে সেহরি পার্টি? ওইদিন এক মন্ত্রীর বউয়ের পার্টিতে গেলাম, পেট পর্যন্ত গয়না পরেছিল সেই মহিলা।
আমি বলি, ঠিক আছে বন্ধু-বান্ধব মিলে সেহরি খাই, গেট টুগেদার করি ঠিক আছে, কিন্তু এই মেকাপ দিয়ে সেহরি খেয়ে ছবি তুলে দিতে হবে কেন ফেসবুকে? আর কেউ কারো জন্য কাঁদে না, কেউ কারো কথা ভাবে না…আমার দুই মেয়ে, ওদেরকে বলি বেশি বেশি করে বাইরে যাও, মানুষের সাথে মেশো, তাদের কথা বোঝার চেষ্টা করো…”
আমি মহিলার দিকে তাকাই। মনে হয় একবার একটু আলিঙ্গন করি। যে ট্রমা কাটাতে চুলে মাসাজ নিচ্ছি সেই ট্রমা আসলে মাসাজে কাটবে না, কাটবে মানুষের সাথে আলিঙ্গনে। বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে আমাদের বের হতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নাই। নাই।
নাই, কারণ আমাদের অভিভাবক এখনও বলে চলেছেন, কোনটা সহী ইসলাম আর কোনটা না। এখনও সহী হলে সেই ধর্মকে মাথায় করে নাচতে পছন্দ করছেন তিনি। একবারও শান্ত আর্দ্র স্বরে তিনি বললেন না, আমি দু:খিত। আমি দু:খিত আমাদের অতিথি আর দেশের মানুষদের আমি রক্ষা করতে পারিনি। একবারও বলছেন না, এই দেশটা হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ সর্বোপরি সব মানুষের। একবারও বলছেন না, আপনারা আমার পাশে থাকুন।
একটা আলিঙ্গনের জন্য আমি তাই তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি। আমি জানি, এই তৃষ্ণা আজ অনেকের বুকেই। তাই বলি, গোল হয়ে আসুন সকলে, ঘন হয়ে আসুন সকলে। আমার মিনতি আজ স্থির হয়ে বসুন সকলে।
আসুন, আলিঙ্গনে বাঁধি একে অপরকে।
ইশরাত জাহান ঊর্মি: লেখক ও সাংবাদিক
চমৎকার লেখা. খুব ভালো লাগলো পড়ে. অনুমতি ছাড়াই করলাম.