গুলশানে জিম্মি হত্যা ও আমাদের প্রতিবাদ

অনীলা পারভীন: ঢাকার অভিজাত পাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি হামলার ঘটনায় জঙ্গিসহ মোট মৃতের সংখ্যা ২৮ জন।  এই ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

এতোদিন যারা ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, হিন্দু পুরোহিত বা অন্যান্য ‘মানুষ’ হত্যায় কোন প্রতিবাদ করেনি, বরং “আমি মানুষ হত্যা পছন্দ করি না, কিন্তু আল্লাহ রাসুলকে গালিগালাজও তো সহ্য করা যায় না”; কিংবা “মুক্তচিন্তা মানেই ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা নয়” ইত্যাদি বলে ব্লগার, লেখক ও অন্যান্য হত্যায় প্রকারান্তরে ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলেছিল, কিংবা মৃদু সমর্থন জানিয়েছিল, তারা আজ  প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে।

Gulshan 3অথবা পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও তাদের চৈতন্য উদয় হচ্ছে। যদিও বহুদিন ধরেই বলার চেষ্টা হচ্ছিল যে, এসব হত্যাকাণ্ডই জামাতি/মৌলবাদিদের রাজনীতির অংশ। বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা, সেসব কথায় অনেকেই কর্ণপাত করেনি।

আশার কথা হচ্ছে, দেরিতে হলেও তাদের বোধোদয় হয়েছে, শুভবোধের উদয় হয়েছে।

কেউ কেউ এখন বলছেন- ‘সময় এসেছে আমাদের প্রতিবাদ করার, এক হয়ে নিজেদের রক্ষা করার।‘ এমন সব সুন্দর সুন্দর প্রতিবাদী কথা আজ আমরা Facebook-এ দেখতে পাচ্ছি। এখন কথা হচ্ছে- প্রতিবাদটা আসলে কিভাবে করা হবে।

আমরা যারা আম-জনতা তারা কি মাঠে নেমে মৌলবাদীদের মোকাবিলা করবো বা করতে পারবো? সেটা আসলে সম্ভব না। অথবা শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতে দু’কলম লিখে প্রতিবাদ করেই মনে করবো, অনেক কিছু করে ফেলেছি? সেটাও কি আসলে খুব কার্যকর পন্থা? মোটেই না, তাহলে?    

সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমরা জেনেছি, হলি আর্টিজেন বেকারিতে অস্ত্রধারীরা সবাই কোনো না কোনো ইংলিশ মিডিয়াম কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ পর্যন্ত যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম আমরা জানতে পেরেছি, সেগুলো হচ্ছে-(১) নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (২) মানারাত ইউনিভার্সিটি এবং (৩) স্কলাস্টিকা।

আমরা আগেও দেখেছি, ব্লগার রাজিব হায়দার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি’র ছাত্ররা। সুতরাং আমাদের ছেলেরা কোথায় পড়ছে? কার সাথে মিশছে? সেটা নজর রাখা বাবা-মায়ের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। সন্তানকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর দিন শেষ।   

Anila Pervinএরপর আসুন দান-খয়রাতের ব্যাপার নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক, আমরা কোথায়, কাকে, কোন মসজিদ বা মাদ্রাসায় দান করছি, সেটা যেন জেনে বুঝে দান করি। আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ, আমার কষ্টের টাকায় জঙ্গি তৈরি হবে কিনা? আমার টাকায় মানুষ মারার জন্য চাপাতি কেনা হবে কিনা? মানুষ হত্যার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে কিনা? আল্লাহর রাস্তায় দান করতে গিয়ে আল্লাহর বান্দাদেরই জীবন ধংসের কাজে যেন পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করি।  

আমাদের চারপাশে প্রচুর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি মালিকানাধীন ব্যাংক, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়,ইন্সুর‍্যেন্স কোম্পানি, কোচিং সেন্টার এবং আরও অনেক রকম প্রতিষ্ঠান আছে। ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলিকে চিহ্নিত করে এবং কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারন করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদেরকে গোয়েন্দা নজরদারিতে নিতে হবে; এসব প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করতে হবে।

আমাদের যে সব বন্ধু বা প্রতিবেশী এমনকি যদি ঘরের লোকটিও উগ্র মানসিকতা পোষণ করে তাকে বর্জন করতে হবে। কারণ আমরা জানতেই পারবো না, কখন কিভাবে সে আমাকে/আমাদেরকে তাদের টার্গেটে পরিণত করে ফেলেছে। এদের কাছে কেউ আপন নয়, কেউ নিরাপদ নয়।    

Gulshan 6আমরা ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ জাতি না; তবে আমাদের আম-জনতার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন যে হচ্ছে না তা নয়; আমরা কি ভুলে যাবো আমাদের অসাম্প্রদায়িক সুন্দর একটি সমাজ ছিল, দেশ ছিল! আমরা মডারেট মুসলিম ছিলাম, সেখান থেকে মনে হচ্ছে আমরা সরে যাচ্ছি। আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে বদলে দিচ্ছে; এক সময় আমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবার স্বপ্ন দেখতো; তাদের মধ্যে অনেকেই মানুষের মতো মানুষ হতো; বাবা-মা পরিবার-পরিজনরা তাদের নিয়ে গর্ব করতো; আমার সেই সোনার বাংলাদেশটি কোথায়?

এখন আমার দেশের ছেলেরা জঙ্গিদের মতো মুসলিম হচ্ছে কেন? শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে অশান্তি সৃষ্টি করছে কেন? চাপাতি দিয়ে ইসলাম কায়েম করার চেষ্টা করছে কেন? ইসলাম ধর্ম তো বাংলাদেশে নতুন আসেনি। জঙ্গিবাদ নতুন এসেছে; আমাদের অনেকে না জেনে না বুঝে মনে করে থাকেন, জঙ্গিবাদের বিরোধিতা মানেই ইসলামের বিরোধিতা; ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের জন্য কখনই সমস্যা ছিল না। এখনও সমস্যা নয়। সমস্যা জঙ্গিবাদ এবং জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস। সাধারণ মানুষ সেই পলিটিক্সটা বুঝতে পারছে না কারণ তারা জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলেছে। ইসলামের মোড়কে একটি গোষ্ঠী তাদের মধ্যে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের বীজ বপন করছে।

সাধারণ মানুষকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন করতে হবে; তারা যদি এই পলিটিক্স বুঝতে পারে তাহলে সমস্যা সমাধান অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমাদের সেটা পারতেই হবে, আমাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। তা না হলে দুই দিন আগে আর পরে আমরা একদিন সবাই লাশ হয়ে যাবো, শোকের মাতম করার জন্যও কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

[সিডনি,অস্ট্রেলিয়া থেকে]

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.