মারজিয়া প্রভা: রাতে আমি ঘুমিয়েছিলাম, ভালো ছিলাম। ঘুমের মধ্যে আমি জঙ্গি কী, গুলশান কী, হামলা কী, কিছুই বুঝতে পারিনি! ভালোই ছিল, সংঘর্ষের আপডেট আমাকে টাইম টু টাইম দেখতে হয়নি! দেখে আমি কী করতাম?
আমার মন ভালো নেই আজ! সকালে উঠে অফিসে যাওয়ার সময়ে ছোট্ট মেসেজ পাই, “অফিসে আসতে হবে না, নিরাপদে থাকুন”। আমি অবাক হয়ে ফোন দেই। কিচ্ছু জানি না আমি! রাতে প্রচুর মাথা ব্যথা করেছিল, বিলি বিলি করে তেল পানি দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। মা হয়তো একবার বলেছিল, “কাল অফিসে যেও না, গুলশানের অবস্থা খারাপ”।
মাথাব্যথায় আর ঘুমে কিচ্ছু জানতে চাইনি।
আমার অফিস গুলশান ১ এ। খুব বেশি দূরে নয়। গুলশান ২ এর ওই রেস্টুরেন্টটিতে প্রায়ই বিদেশিরা আসতো। কালও এসেছিল। ঘুণাক্ষরে কি জানতো জিম্মি হতে হবে ওদের? ইসলাম ধর্মের নামে কেউ এসে তাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে?
নিউজ আসছে, আমি দেখছি। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ১০ ঘণ্টায় জিম্মি সমস্যার সমাধান করেছেন তারা, কমান্ডো অভিযানে!
প্রধানমন্ত্রী নিজেকে নিরাপদ ভাবছেন? ভাবতে পারছেন রবিউল আর সালাহউদ্দিনের পরিবার কী দুঃসহ জীবন পার করবে বাকি জীবন? রবিউলের অনাগত সন্তান জানবে জঙ্গিবাদ তার বাবার জীবন কেড়ে নিয়েছে! কত অল্প বয়স থেকে ‘জঙ্গি’ কথাটার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে ওদের!
প্রধানমন্ত্রীর কি মনে পড়ছে, অভিজিৎ রায়কে যখন মেরে ফেললো, তখন চুপিচুপি তিনি তার বাবা অজয় রায়কে গিয়ে সান্ত্বনা জানিয়ে এসেছিলেন! তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন, “আমরা (আওয়ামী লীগ) নাস্তিক হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। তবে এতে আমাদের মূল আদর্শের কোনো বিচ্যুতি হবে না। আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী।”
তখন কি জানতেন না এই দিনটি আসতে পারে! কিংবা তারও আগে থাবা বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছিল ঈশ্বর অবিশ্বাসী লেখালেখির দরুন, তখনও কী উনি ভাবেননি, কাকে মদত দিচ্ছেন?
নাস্তিক কি এই দেশের নাগরিক না? আদিবাসী না? সংখ্যালঘু না? নাকি তাদের ভোট সব মিলিয়ে বড়জোর ৩০% হবে বলেই তাদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই? বরং হেফাজতকে হাতে রাখলে, কথায় কথায় “ধর্ম নিয়ে কেউ কটূক্তি করলে তাকে বরদাশত করা হবে না” বললেই ভোটের পাল্লাটা ভারি হয়!
“লেখায় লাগাম” টানার বদলে একবার যদি জঙ্গিদের, হামলাকারীদের লাগাম টানতেন এই এতোগুলো বছরে, তাহলে কি আজকের “জিম্মি” ব্যাপারটাই আসতো? ধর্মান্ধ মানুষদের মদত দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকেই ঠেলে দিয়েছে অনিরাপত্তার দিকে!
অভিজিৎ, অনন্ত, বাবু, নিলয়, পুরোহিত, ঠাকুর, পাদ্রী! কার হত্যার বিচার পেয়েছি আমরা! সরকারের লোক “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চুপ থেকেছেন! এভাবে জঙ্গিবাদ জিইয়ে রেখেছেন, তা কি তিনি সত্যিই বুঝতে পারেননি?
খোলা ময়দানের ওয়াজে নাস্তিক আর পশ্চিমাদের নিয়ে গালাগালি করা হয়। কত ছোট কোমলমতি শিশুদের মনে কি নোংরা জঙ্গিবাদের বীজ বপন করে দেওয়া হয়!
চাইলে কি আইন দিয়ে এই সবকিছু বন্ধ করা সম্ভব ছিল না? চাইলে কি শিক্ষানীতি বদলে মাদ্রাসার শিক্ষা মেইনস্ট্রিম শিক্ষার আদলে করা যেত না!
জঙ্গি পুষেছে সরকার। জঙ্গি পুষেছি আমরা! ঘুমিয়ে থেকেছি। ইসলাম জঙ্গি সমর্থন করে না বলে হাঁফ ছেড়েছি!
কিন্তু হে ধর্মপ্রাণ মুসলিম, কতবার জুম্মা নামাজের খুতবায় নিজে গিয়ে ইমামকে বলেছ, “ইমাম খুন নিয়ে কিছু তো বলেন! এ তো ইসলামকে নিয়ে নোংরামি হচ্ছে। চলেন কিছু খুতবা দেন! খুন বন্ধ করতে”।
এক নাস্তিক ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করলে তোমার ধর্মের যতটা ক্ষতি না হয়, এক জঙ্গি সেই ধর্মের নামে খুন করলে ধর্মের আর কিছুই থাকে না! এভাবে খুনের ধর্ম বিস্তার করতে করতে ধর্ম তোমার এমনিতেই বিনাশ হবে। সেই সাথে তুমিও।
জিম্মি করেছে বিদেশীদের, তাও সিয়াম সাধনার মাসে। তাও জুম’আতুল বিদার রাতে।
কদিন পর শপিং মল, সিনেমা হল জিম্মি করবে! তারপর সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি, তোমার আমার বাড়ি, সরকারি সব প্রতিষ্ঠান একটু একটু করে জিম্মি করবে। পুরো বাংলাদেশ জিম্মি হবে একদিন! সেদিনও ঘুমিয়ে থাকলেই বোধহয় ভালো হবে!
প্রিডেটর মুভির ডায়লগ থেকে বলতে ইচ্ছে করছে “We all gonna die”. সত্যিই সে সময়টা চলে এসেছে!