প্রসঙ্গ: বাবুল আক্তার ও আমাদের সাংবাদিকতা

আমিনুর রশীদ: সংবাদ মাধ্যম যদি ভুল, বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করে থাকে, তার দায়ভার যতোটা না সাংবাদিকের, বিশেষভাবে মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়, তার চেয়ে বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এটা আমার অভিজ্ঞতা। কর্মসূত্রে পাওয়া অভিজ্ঞতা।

13566200_10208282098462960_379545567_n
আমিনুর রশীদ

সাংবাদিকরা গালমন্দ খাবে। ভুল করলে, উদ্দেশ্যমূলক কিছু করলে, রগরগে হলুদ সাংবাদিকতায় মাতলে তাদের গালমন্দ খেতে হবে এবং খাওয়াই উচিত। তাদের বিচারও হতে পারে। সাংবাদিকরা এই সমাজেরই অংশ। তারা সমাজবহির্ভূত দেবতা না। তাদের বিচারটা বরং সবার আগে হওয়া উচিত। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার আগে :

ক. বাবুল আক্তারের মতো জাঁদরেল পুলিশ অফিসারকে তুলে নিয়ে গিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ১৫ ঘন্টা ধরে গ্রেপ্তারকৃতদের মুখোমুখি করাতে হয়! এটা বিশ্বাস করি কিভাবে? ১৫ ঘন্টা?

খ. তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার শ্বশুর সংবাদ মাধ্যমকে কী বলেছিলেন, সেটা একটু স্মরণ করি (তুলে নেয়া, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, পুলিশ প্রহরা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি)।

গ. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি কিংবা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা কি ঝেড়ে কাশছেন? তারা প্রচুর ‘যদি’ ‘কিন্তু’ দিয়ে কথা বলছেন। তাদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা দরকার। তার চেয়ে বেশি দরকার ‘বিটুইন দ্য লাইনস’ বোঝা। তাতে যদি, যদি-কিন্তুগুলোর কিছু অর্থ পরিস্কার হয়!

ঘ. সাংবাদিকরা তাহলে কী করবে? যদি-কিন্তুর বিভ্রান্তিতে পড়া ছাড়া? কেউ একজন থাকবেন তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, যিনি যদি-কিন্তু বাদ দিয়ে সরাসরি বলে দেবেন, সংবাদ মাধ্যম যা করছে, তা ভুল। তা অনাচার। তারা বলতে পারেন, আপনাদের সব তথ্য মিথ্যা। সেটা কে বলছে, কাকে বলছে?

বাবুল আক্তার পুলিশ অফিসার হিসেবে দেশের জন্য বিরাট সম্পদ। তিনি যা করেছেন, তা তার কর্মক্ষেত্রের বহু মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার বোধ তৈরি করেছে। এগুলো সেই সব এলাকার মানুষের কাছ থেকেই শোনা। তাকে শেষ পর্যন্ত আমরা সেই জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ত্রাস হিসেবেই পুলিশ বাহিনীতে ফেরত চাই।

Police Super Babulপাশাপাশি আমরা মিতুর ঘাতকদের সম্পর্কেও প্রকৃত সত্যটা জানতে চাই।

অবোধ পুত্রের সামনে মাকে হত্যার এই নির্মম দৃশ্য বালকের মন থেকে কখনোই মুছবে না। বিভৎস, ভয়ঙ্কর এক আতঙ্ক মাথার গভীরে নিয়ে এই শিশুটি বড় হবে! সে বড় হবে, পরিণত হবে, প্রবীণ হবে। তারপর একদিন মারা যাবে। কিন্তু এই স্মৃতি? এটা আতঙ্কের ছায়া হয়ে আজীবন তার পাশে পাশে হাঁটবে। তাকে দুমড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে দেবে।

কিন্তু যদি হত্যাকারীদের ধরা হয়, আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যদি ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়, তাহলে হয়তো এই শিশুটির মনে সান্তনার ছোট্ট একটা প্রলেপ দেয়া যাবে।

এই শিশুটি জানুক তার মার প্রকৃত ঘাতককে। এটা নিশ্চিত করা দরকার, যে কোন মূল্যে। এটা এই শিশুটির জন্য দরকার। আমাদের, সমাজের, রাষ্ট্রের মননে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষত সারাতেও দরকার। আইন বলে যে জিনিসটি আছে, তাকে সম্মান করতেও দরকার।

লক্ষ লক্ষ বাবা-মা প্রতিদিন সকালে তার আদরের সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যান। তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘ যন্ত্রণাকাতর সময় কাটান তারা, রোদবৃষ্টিতে ভিজেপুড়ে। তাদের মনের শান্তির জন্যও এটা দরকার।

সবচেয়ে বড় কথা, আমরা ক্রসফায়ার কিংবা বন্দুকযুদ্ধে কারো নিহত হওয়ার খবর শুনতে চাই না। আমরা ঘাতকের মুখ দেখতে চাই। তাদের সামারি ট্রায়াল চাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদন্ডের পক্ষে না। পছন্দের বাইরে গিয়েও এই ঘাতকদের মৃত্যুদন্ড চাই। সবচেয়ে কম সময়ে সেই দন্ডের কার্যকারিতা দেখতে চাই।

সাংবাদিকতা করি। কিন্তু সাংবাদিকদের পক্ষে এটি কোন সাফাই নয়। পুলিশের বিরোধিতাও নয়। একজন মানুষ হিসেবে এটি আমার ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকাতরতা। আমি নিজেকে মিতুর জায়গায় ভাবি। তার শেষ সময়ে সেই অসহায় মুহূর্তটিতে নিজেকে ভাবি। হত্যাকাণ্ডের সময় আমি নিজেকে তার বালকপুত্রে প্রতিস্থাপন করি। তাতে বড় অসহায় বোধ করি।

আমি খুব আকুল হয়ে চাই, এই রিপোর্টগুলো মিথ্যা হোক। এই রিপোর্টের রিপোর্টারদের শাস্তি হোক। সম্পাদকদের শাস্তি হোক। সাংবাদিক হিসেবে আমার শাস্তি হোক।

লেখক: হেড অব নিউজ, চ্যানেল নাইন

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.