বিথী হক: আমি ঠিক কত আগে প্রথম লেখালেখি শুরু করেছিলাম সেটা মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে স্কুলে পড়ার সময় হবে হয়তো। ছড়া, ছোট গল্প, কবিতা, তারপর সমসাময়িক ইস্যু; এখন অবশ্য নারী অধিকার নিয়েই বেশি লেখা হয়। সেই সূত্র ধরেই “উইমেন চ্যাপ্টার” এর সঙ্গে পরিচয়।
আমার প্রায় বেশিরভাগ লেখাতেই মানুষজনের গালাগালি থাকে, আদার ইনবক্স খোলার সাহস পাই না মাঝে মাঝেই। আমার কাছের মানুষরা ভাবে-ভঙ্গিতে কিংবা কখনো সরাসরি বলে ফেলে এসব নারী অধিকার বা সমাজসেবার উদ্দেশ্যে লেখা লিখে কিছু উদ্ধার হবে না। কি দরকার অত বড় বড় কথা বলার, লেখার! সমাজ কি পরিবর্তন হচ্ছে? কারো মানসিকতার কি একটুও পরিবর্তন হচ্ছে?
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলি, আমার শুরুটা বেশিদিনের নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বয়ে আসা সংস্কারকে এক তুড়ি মেরে- তাতে পরিবর্তনের আশা করা নির্বুদ্ধিতা। দু’চার বছরের ভেতর যে সবকিছু বদলে যাবে এমন আশা করাও বোকামী। আমি যুগের হিসাব করি, শতাব্দীর হিসাব করে লিখি বা বলি; রাতারাতি কোনকিছু পরিবর্তনের আশায় নয়।
তবুও আমার জীবদ্দশায় আমার কথা শুনে, আমার দুর্বল লেখা পড়ে একটা মেয়েও যদি ঘুরে দাঁড়ায়, একটা ছেলেও যদি মেয়েটার হাত ধরে পাশে দাঁড়ায় একসঙ্গে হাঁটার জন্য, তবে সেটাই আমার প্রাপ্তি। সেটাই আমার বলা হাজারটা কথার, লেখার, স্বপ্নের পূর্ণতা!
আমার কথা শুনে সবাই হাসে। হাসারই কথা! আমার কি এমন যোগ্যতা আছে সমাজ পরিবর্তনের, কি এমন করছি আমি? আমার মত এরকম বড় বড় কথা তো সবাই বলতে পারে!
অফিস থেকে ফিরে পিসি অন করে দেখলাম এক ছেলে একটা ছবি ইনবক্স করেছে। রান্নার ছবি, ক্যাপশনে লেখা ‘আপু এটা আমার বানানো আজকের ইফতার’। আমি জানতে চাইলাম সে তো নাকি রান্না জানে না, তাহলে এসব ইফতার কিভাবে বানালো! তার নির্লিপ্ত জবাব, ‘জানতাম না, আজকে শিখলাম এবং এগুলো রান্না করলাম!’
এই ছেলের সঙ্গে মাসখানেক আগে একবার কথা প্রসঙ্গে জানলাম সে রান্না জানে না। কথাটা বলার সময় তার বলার ধরনে বুঝেছিলাম, রান্না না পারায় তার ভেতর কিছুটা ঔদ্ধত্য আছে, যেন রান্না না জানাটা খুব সম্মানজনক ব্যাপার। এই ঘটনার আগেই উইমেন চ্যাপ্টারে রান্না বিষয়ক একটা লেখা জমা দিয়েছিলাম।
‘রান্নাঘর বনাম পৌরুষের সম্মান’ শিরোনামের সেই লেখায় প্রচলিত সমাজের পুরুষদের রান্নায় অনীহা এবং রান্নাকে অসম্মানজনক মনে করার সমালোচনা করেছিলাম। সে নাকি নিয়মিত আমার লেখা পড়ে এবং বিষয়গুলো নিয়ে ভাবে। এখন তার আগের ভাবনাগুলো নিয়ে সে নাকি প্রায়ই বিব্রত হয়। কোনো বিষয়ে খটকা লাগলে সে আমাকে ইনবক্সে প্রশ্ন করে।
এর আগে বেশ কিছু মেয়ে ছিল যারা নারীবাদ নিয়ে সারাক্ষণ উল্টাপাল্টা মন্তব্য করতো, আমাকে গালাগালি করতো; ক’দিন ধরে আমার লেখার অংশবিশেষ কপি করে নিজের টাইমলাইনে দিতে দেখছি। বেশ কিছু বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করতেও দেখতে পাচ্ছি কয়েকজনকে।
সবচেয়ে মজার বিষয়, আমাকে কেউ গালাগালি করলে সেটার স্ক্রিনশট আমাকে দিয়ে তার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধও করছে। সেদিন একজনকে দেখলাম আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলায় তারই এক বন্ধুর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া লাগিয়ে ফেলেছে।
পরিশেষে, ডিয়ার হেটারস, আমি সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য লিখি না। আমার অসিলায় একটা মানুষও যদি পরিবর্তন হয়, আমি সার্থক। আমি কতোটা সফল, কতোটা বিফল সেটা পরিমাপের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েন না। আপনি জানেন না, আপনার কাছে যেটা পরাজয়; আমার কাছে সেটা বিজয় মুকুট।
কোন এক গ্রীষ্মে আমরা দ্বিগুণ হবো। কে জানে, পাশের সহযোদ্ধাটা আপনিও হতে পারেন।