বিবাহিত নারীর নাম নিয়ে রীতি-নীতি

মাকসুদা আজীজ: আমার নামটি রেখেছেন আমার দাদাজান। আমার বড় বোনের নাম সুবেহ তেরেসা। এমন আধুনিক নামের মেয়ের বোনের নাম মাকসুদা আজীজ কীভাবে হয় এটা একটা বিরাট ইতিহাস।
তবে আমি আমার নামটা নিয়ে হেভি প্রতাপের সাথে জীবন যাপন করছিলাম।

Womenএই প্রতাপের কারণ স্কুলে আমি বিরাট মাতব্বর ছিলাম। এক নামে চিনে অবস্থা। গোল বাঁধলো ক্লাস নাইনে এসএসসি’র জন্য রেজিস্ট্রেশন করার সময়। হঠাৎ সায়লা হোসেন হয়ে গেল সাইবা জান্নাত, জেনিফার ইসলাম হয়ে গেল জেবা মুনাওয়ারা, রুখসানা ইসলাম হয়ে গেলে এ্যানি ইসলাম। দল ধরে সবাই নাম বদলাচ্ছে।

টিচাররা পরে বাধ্য হলেন নিয়ম করে দিতে যে নাম বদলাতে হলে বাবা-মায়ের শ্রেণি শিক্ষকের সাথে সাক্ষাৎ করে মৌখিক এবং লিখিত অনুমতির সাপেক্ষেই কেবল নাম বদলানো হবে। তারপরেও নাম বদলানোর দল তেমন পাতলা হলো না। কারণ নাম বদলানোর এই শেষ সুযোগ।  
আমিও ভাবলাম বদলে ফেলি, পরে ভাবলাম নাম বদলানো অর্থ হচ্ছে আমাকে আবার পাওয়ার আর্ন করতে হবে। কে করে এতো কষ্ট!
এরপর থেকে আমি মাকসুদা আজীজ, ফর এভার এ্যান্ড এভার (মানে ঐ জনম জনম আর কি!)। নিজের নাম বদলের বিষয় আর জীবনেও কোনোদিন মাথায় আনতে হতে পারে এটা আমি জীবনেও ভাবি নাই। কিন্তু আমাকে আবার ভাবতেই হলো।
আমার যখন বিয়ে হয় আমি তখন খানিকটা কচি এবং দিন দুনিয়ার ভাব-আদর্শ সম্পর্কে কাঁচা। সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে আমার একজন ফ্রেন্ড-ইন-ল ( ফিঁয়াসের বন্ধু আর কি) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিয়ের পরে আমার নাম কী হবে?
হায় হায়! বিয়ের পরে আমার অন্য নাম হবে মানে? নাম বদলানোর সুযোগ না ক্লাস নাইনে শেষ হয়ে গেছে? এরপর আমার মনে পড়লো, আরে এই হারামি তো আমার পদবী বদলানোর কথা বলে!

নাম নিয়ে বিস্তর লেখাপড়া করলাম। কে জানে আরও কে কে এই প্রশ্ন করে বসে!
নাম বদলালে সকল সার্টিফিকেটেও বদলাতে হবে এই যুক্তির বাইরেও আরেকটা ভালো যুক্তি বের করলাম। বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম, এই নাম বদলানোর বিষয়টা এসেছে মূলত ভারতীয় হিন্দু এবং ইউরোপের খ্রিস্টানদের থেকে।

13115325_10207873053117082_679485265_nভারতীয় হিন্দুরা কারও কারও মাঝে এবং সর্বকালের সর্ব প্রগতিশীল ব্রাহ্ম্য সমাজেও বিয়ের পরে নাম বদলানোর রীতি ছিল। এই ভয়াল রীতি শুধু পদবী বদলানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, কেউ কেউ তো সম্পূর্ণ নামই বদলে দিতেন! এই কাজে ঠাকুরবাড়ির লোকদের তো কোনো তুলনাই ছিল না। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, কারও বিয়ে হলে রবীন্দ্রনাথ তাকে একটা নতুন নামই গিফট করতেন!

বিয়েতে রবীন্দ্রনাথের থেকে নাম গিফট পেয়েছিলেন এমন একজন হলেন কবি নবনীতা দেব সেনের মাতা রাধারানী দেবী। রাধা রানী সেই যুগেই খুব প্রগতিশীল নারী ছিলেন। কবিতা লিখতেন, বিয়ের আগে তার তিনটি বইও বের হয়েছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথের একজন অনুরাগীও ছিলেন। তার বিয়ের খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ বড় মুখ করে নতুন নাম উপহার হিসেবে পাঠিয়ে একটি চিঠি পাঠালেন। রাধা রাণী তার যেই জবাব দিয়েছিলেন, তার জন্য রাধা রাণীকে আমি শতবার কদমবুছি করি।
রাধা রাণী লিখেছিলেন, আমার নাম আমার পরিচয়। এই নামে লোকে আমাকে চিনে। বাজারে এই নামে আমার তিনখানা বই রয়েছে। এ নাম আমার পক্ষে বদলানো সম্ভব নয়।

তবে রবীন্দ্রনাথ আর রাধা রাণীকে ঘাটাননি। সেই ঘটনার আট বছর পরে রাধা রাণীর কন্যার জন্ম হয়। বিয়ের পরে দেওয়া সেই নামটি রবীন্দ্রনাথ মায়ের বদলে তখন মেয়েকে দেন। তিনি কন্যার জন্মের খবর পেয়েই কন্যার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখেন, সম্বোধনে সেই নাম, নবনীতা।         

বাঙালী মুসলমানের অবস্থা বুঝা খুব দুষ্কর। একদিকে তো ধর্ম রক্ষা, আরেকদিকে ট্রেন্ড! পুরাই শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশা! প্রগতিশীল হিন্দুদের সাথে আছে মহা প্রগতিশীল ইউরোপিয়ান প্রভাব। ইউরোপের সংস্কৃতিতেও বিয়ের পরে আর নারী আপন পরিচয়ে থাকেন না, হয়ে যান মিসেস অমুক-তমুক। বাঙালী মুসলিমও যখন পাশ্চাত্যের শিক্ষায় এগিয়ে এলেন, তারাও আর বাসার নারীদের নামকে না ধরে থাকতে পারলেন না।

13487401_10208204477882494_2058563156_n
মাকসুদা আজীজ

প্রমথ চৌধুরী তো বলেছেনই, “ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।” তাই বাঙালী মুসলমান নারী শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নে ইত্যাদি পিছিয়ে থাকলেও পদবীতে ঠিক ঠিক হাত পড়ে গেল। না হলে ভেবে দেখেন, আরবীয় মুসমান নারীদের নামের ফর্মেট হচ্ছে, মোসাম্মত+ নিজের নাম+বিনতে+বাবার নাম। এই নামে আকিকা হয়ে যায়, এরপর আবার বিয়ের পরে নাম বদল হয়। কয়জন ধর্মপুত্র যুধিষ্টির আর বিয়ের পরে বৌয়ের নামে আকিকা দিয়েছে?

তাহলে আমরা ইসলাম থেকে কী নিলাম? স্ত্রী নিলাম, তার শাসনের ভার নিলাম, দেনমোহর মুখে মুখে দিলাম, এরপর খানিকটা যৌতুকও নিলাম, কারণ সবাই নেয়। কী দরকার এখানে বলা যে যৌতুক নেওয়া হিন্দুদের প্রথা? এগুলা বলতে হয় নাকি? তওবা! এরপর নিয়ে গিয়ে বৌয়ের নাম বদলে ডুগডুগি বাজিয়ে শাসন করলাম! বলুন বেশ বেশ বেশ!

নাম বদলের প্রকোপ আমাদের পূর্ববর্তি প্রজন্মের থেকে আমাদের প্রজন্মে তুলনামূলক কম। এর একটা কারণ আমার মতো অনেকেরই নিজের পরিচয়ে খুব ভালোবাসা জন্মে যায়। আরেকটা কারণ সার্টিফিকেট বদলানো খুব কঠিন প্রক্রিয়া। তবে সম্প্রতি জানতে পেরেছি স্বামীর পদবী ধারণ করা নাকি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তাই অনেক মেয়ে নিজ উদ্যোগেই সার্টিফিকেটে না হোক, ফেইসবুকে বদলে নিচ্ছে। ভালোবাসার বলিহারি! নিজের নামটা তো অন্তত সেকেন্ড নামে রাখা যায় নাকি? সার্চ অপশনে গিয়ে তো এসব নাম হারানো মানুষদের খুঁজে পাই না। এ কথা গায়ে পরে বলতেও চাই না, কার ভালো লাগে অন্য লোকের মুখে শুনতে আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি কী বাসি না!   

শেয়ার করুন:

নাম বদলের প্রকোপ আসলেই এই প্রজন্মে অনেক কম। এটা নিয়ে একটা ফানি অভিজ্ঞতা আছে। হাসপাতালে বেবি হয়েছে, নার্স এসে আমাকে বললো বাবুর নাম, আমার নাম আর আমার স্ত্রীর নাম লিখে দিতে একটা কাগজে। আমি নাম লিখলাম এভাবেঃ

১। বাবুর ডাক (বড় নাম এখনো রাখা হয়নি)
২। স্ত্রীর নাম
৩। আমার নাম

পরে দেখি হাসপাতালের বার্থ সার্টিফিকেটে আমার লাস্ট নেমের স্থানে আমার স্ত্রীর লাস্ট নেম। পরে বুঝলাম, ওরা ধরেই নিয়েছিলো আমার আর আমার স্ত্রীর লাস্ট নেম একই হবে। সব থেকে মজা, আমাদের বাবুর ডাকনামের পাশেও সেই একই কেইস, স্ত্রীর লাসট নেম – পুরা ফ্যামিলি একই লাস্ট নেম বানিয়ে রেখেছে।