সাবিনা শারমিন: ক্রসফায়ারে নিহত ফায়জুল্লাহ ফাহিমের লাশ পড়ে আছে। এদের হাতেই খুন হওয়া রাজীব হায়দার, ওয়াসিকুর রহমান বাবু, অভিজিৎ- অনন্তদের লাশ পড়েছিলো রাস্তার ধারে। যারা মেরেছে সেই তাদেরই একজন আবার মরেছে। এই দু’য়ের, খুন করা এবং খুন হওয়ার, মূল কারণ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।
যে বিষয়কে কেন্দ্র করে এই হত্যা-খুন তার উৎস দেড় হাজার বছরের পুরনো, যা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ।
জঙ্গি-মুক্তমনাদের এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের হোলি খেলায় অকারণে ঝড়ে যায় কতগুলো তরুণ প্রাণের। নিঃস্ব হয় সে প্রাণের কাছের মানুষগুলো, যারা নিরপরাধ এবং নির্দোষ। আর স্বার্থের ঝুলিতে লাভের কড়ি টোকায় রাজনৈতিক সুবিধাবাদিরা।
প্রশ্ন হচ্ছে কী এমন কারণে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯ বছর বয়সের এই ছেলেটি পরিবারের সমস্ত মায়ার বন্ধন ছেড়ে একজন শিক্ষককে হত্যা করার জন্যে চাপাতি হাতে নিলো? হত্যা সফল হলে তার প্রাপ্তিই বা কী? এই ছেলেটি কি কখনো নিরীহ ছিলো?
জঙ্গিবাদের মদদ দাতা যেই হোক না কেনো,এ নিয়ে কথা বলা,এর কারণ অনুসন্ধান করতে চাওয়া এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কাউকে দোষারোপ না করে নৈর্ব্যক্তিকভাবে এর কারণ অনুসন্ধান করা উচিৎ। একজন মা হয়ে, অভিভাবক হিসাবে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে পড়ার টেবিল ছেড়ে কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেটি কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, কারা জঙ্গি হওয়ার ইন্ধন যোগায়। কারণ আমার সন্তানের প্রাণ গেলে এবং তার দ্বারা অন্য কারো প্রাণ গেলে সেই ক্ষত আমাকেই বহন করতে হবে ।
সমাজে কখনো কখনো একই ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থে আমরা তা প্রত্যক্ষ করি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে এবং ব্যাখ্যাও করি ভিন্ন আঙ্গিকে।
গত কয়েকদিনের বেশ কয়েকটি ঘটনার কারণগুলো খুব স্পষ্ট এবং কারোই অজানা নেই। গত সপ্তাহে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে সমপ্রেমী হত্যা ও পুলিশের গুলিতে হত্যাকারী মতিনের মৃত্যু, ঢাকা উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজের ছাত্রফায়জুল্লাগ ফাহিমের জঙ্গি হয়ে উঠা ও একজন শিক্ষককে হত্যার মিশনে নামা এবং অবশেষে ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু এবং,কয়েক বছর আগে আমেরিকার রিজার্ভ ব্যাংকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া নাফিসের ৩০ বছরের কারাভোগ – এ সকল ঘটনার শেকড়ই এক এবং অভিন্ন।
মনে পড়ছে আমাদের প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করতে যাওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী তরুণ নাফিসের জঙ্গি হওয়ার কষ্টে তার বাবার ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ার কথা।
প্রথমদিকে নাফিসের বাবা এটিকে এফবিআইয়ের ষড়যন্ত্র বলেই দাবি করেছিলেন । তাই তিনি খুব আত্মবিশ্বাসের সাথেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েও সাক্ষাৎকার দিতেন, কারণ তাঁর বিশ্বাস ছিল সন্তানের ওপর, তিনি ভেবেছিলেন, তার সন্তান নিরপরাধ। কিন্তু তা ভুল প্রমাণ করলো নাফিস নিজেই। উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ হয় যে নাফিস সত্যিই এক দুর্ধর্ষ জঙ্গি।
কিন্তু নাফিসের পরিবার, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, কেউ কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে কখন এবং কিভাবে জঙ্গি হয়ে উঠেছে। সন্তানের জঙ্গি হয়ে ওঠার কারণে কর্মস্থল নাফিসের বাবাকে অগ্রিম অবসর দেওয়া হয়েছিল।
ফাহিমের এই করুণ পরিণতিতে তার পরিবারেও হয়তো নেমে আসবে এমন ঘোর অন্ধকার, যাতে রাজনীতি বা ধর্মনীতির কিছু যায় আসে না। ফাহিম-নাফিসেরা কখনো রাজনীতি, কখনো ধর্মীয় বা কখনো অনৈতিক অর্থনৈতিক নীতির বলি।
ধর্মীয়, রাজনৈতিক, আর্থিক যে কারণেই হোক না কেন এই তরুণ প্রাণগুলোর এভাবে অকালে ঝরে পড়া খুবই বেদনা এবং মর্মপীড়াদায়ক। যে তারুণ্যে আছে অপরিমেয় সম্ভাবনা, অপরাজেয় প্রাণশক্তি, যা সমাজ ও জাতির ভাগ্যেন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। এই শক্তির অপব্যবহার রোধ করা না গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।
একটি প্রগতিশীল আধুনিক এবং সুশীল তরুণ প্রজন্ম ছাড়া সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোনদিক দিয়েই এগুনো সম্ভব নয়। রাষ্ট্র কাঠামোতে যত দ্রুত এই সত্যটির প্রতিফলন ঘটবে, ততো দ্রুতই এই হত্যাযজ্ঞ থেকে আমরা মুক্তিলাভ করবো ।
লেখক: সাবিনা শারমিন
[email protected]