চিৎকার করো মেয়ে যতদূর গলা যায়…

সাদিয়া নাসরিন: নিরাপদ নগরও তোমার জন্য হবে না, নির্ভয় পথচলাও তোমার হবে না নারী, যতক্ষণ তুমি না চিৎকার করো, যতক্ষণ তুমি না হাত উঁচিয়ে কলার ধরে টেনে নিচে নামাও অত্যাচারি পুরুষদণ্ড। তোমার জন্য নিরাপদ নগরী তোমাকেই গড়তে হবে। তোমাকেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে পথের গুণ্ডাদের। ভয় নেই । জেনে রাখো, তুমি এগিয়ে এলে ওরা ভয় পায়। ওরা ভয় পায় তোমার কন্ঠের জোরালো চিৎকার। প্রতিদিন ঘরের লড়াইটা ঠিকঠাক শেষ করে বাইরে পা বাড়ানো মেয়ে তুমি, তোমার জন্য ফুল বিছিয়ে রাখেনি কেউ। তাই কাঁটাটা উপড়ে ফেলে পথ তৈরি করতে হবে তোমাকেই।

Punish 2১৩ জুন, বিকাল সাড়ে পাঁচটা, বনানীর … নম্বর সড়ক। অফিস শেষ করে বাসার পার্কিংয়ে গাড়ি ঢুকাচ্ছিলাম। ওয়াসার কাজের জন্য রাস্তা কেটে ফেলায় গাড়ি রিভার্সে দিয়ে ঢুকাতে হচ্ছিল। এমন সময় পেছন থেকে সাউন্ড আসলো , “এই মহিলা রোজা-রমজানের দিনে ঘরে ইফতার না বানাই গাড়ি নিয়া বাইর হইসে কেন?” রোজার শেষ বিকেলে একজন মহিলা(?) ইফতার না বানিয়ে রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে বেড়াচ্ছে, এটা দেখে পুরুষদণ্ড ক্ষেপে উঠলো এই ভদ্র(?)লোকের। এতোদূর পর্যন্ত বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দিইনি। এর চাইতে কত কী হজম করেই ঢাকা শহর দাপিয়ে বেড়াই প্রতিদিন !!!

কিন্তু সে এতে থামলো না। গাড়িটা গেট পার করতেই চরম অশ্লীল একটা উক্তি করলো, সাথে ভঙ্গী। পাশে থাকা আমার স্বামী প্রতিবাদ করতেই তাঁর উপর চড়াও হলো সে।

আচ্ছা!! গাড়িটা পার্ক করে নেমে আসলাম। সোজা ওর বাইকের সামনে গিয়ে ওর কলার ধরে টেনে নামালাম। ঘটনার আকস্মিকতায় ও ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেল। তবে কিছুক্ষণের জন্য। তারপর চরম দুঃসাহসে বাইক তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলো আমার গায়ের উপর। এর মধ্যেই তার পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল গোটা দশ-পনেরটা পুরুষদণ্ড। এর মধ্যে গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী সাহেব (??) থেকে শুরু করে মহল্লার টোকাই ছাত্রলীগ সবই আছে আলহামদুলিল্লা।

Punish 5একটা ‘মহিলা’ মানুষ একটা পুরুষের কলার ধরেছে, তারে ছেড়ে দেয়া যায়? জনতা একজোট হয়ে গেল। এতোক্ষণে পুরা রাস্তার গাড়ি জ্যামে আটকে গেছে। রাস্তার ব্লক ছাড়ানোর জন্য তাকে বললাম আমার বাসার গেটে ঢুকতে। সে কিছুতেই ঢুকবে না। তার সাঙ্গ-পাঙ্গরাও একজোট। হাজী উচ্চকন্ঠে চ্যালেঞ্জ করলো, তাকে কিছুই করতে পারবো না।

কিন্তু কিসের কী? কেউই ভাইগ্নারে বাঁচাতে পারেনাইকা। এক হাতে ব্যাটার কলার ধরি, আর এক হাতে বাইক। সকল হুমকি-ধামকি আর খিস্তিরে বুড়া আঙ্গুল দেখাইয়া বাইকসহ ভাইগ্নারে টেনে ঢুকাইলাম আমার বাড়ির পার্কিংয়ে। এর মধ্যে জামাই বনানী থানায় ফোন করলো। পুলিশ আসার আগেই ব্যাটা গেল পালিয়ে। পুলিশ এসে তার বাইক তুলে নিয়ে গেল। পরে রাতে বাইক ছাড়াতে গেলে পুলিশ তাকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ১০ ধারায় আটক করে।  

Punish 3তারপর তো খালি ভাইগ্নার শিক্ষা সফর। দুই রাত পুলিশের আদর। পরে ভাইগ্নারে ছাড়াতে আসলো অত্র এলাকার কাউন্সিলর মফিজ ( নাম সত্যিই মফিজ)। যেহেতু ১০ ধারায় আটক, কোনো মফিজের কুদরত নাই তারে ছড়ানোর। পরে আর কী! রোজা রমজানের দোহাই, বাচ্চা-কাচ্চার দোহাই,  ওসির রুমে আমার পা ধরে কান্নাকাটি, কান ধরে উঠা-বসা সবই হলো। পরে মফিজ সাহেবের দায়িত্বে ভাইগ্না আমার বাসায় এসে গার্ড , কমিটির লোকজন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত সবার সামনে আর এক দফা পা ধরা, কান ধরা…..ভাইগ্না নিজেই কইলো সে নাকি বুঝতে পারছে কী মাপের জানোয়ার সে। সারাজীবন নাকি সব মহিলারে(?) আম্মা ডাকবো সে।

তবে দিনের সেরা উক্তি করছিল ঘটনার দিন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী সাহেব। আমার জামাইকে বললো, “মিয়া, বউরে শাসন করতে পারেন না? বউ সন্ধ্যায় ইফতার না বানাই গাড়ি চালাইতেছে !!! আমার বউ হইলে তো আমি তালাক দিতাম”। জামাই ব্যাপক বিনুদুন পাইছে। যতোদিন হাজী আওয়ামী লীগের হাতে দেশ, ততোদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ।

ধন্যবাদ জ্ঞাপন: পুলিশ বাহিনী। বনানী থানার ইন্সপেক্টর নাজমুল এতো দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ওই ব্যটাকে ধরে রাখতে পারতাম না হয়তো। তদন্ত কর্মকর্তা এস আই নুরুল হক প্রভাবমুক্ত থেকে রিপোর্ট দিয়েছেন বলেই তাকে সঠিক আইনের আওতায় রাখা গেছে। আর বিশেষ ধন্যবাদ গুলশান জোনের ডিসি মোস্তাক ভাইকে। তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলে এতো দ্রুত এই ‘অমানুষ’গুলাকে শাস্তি দেয়া যেত না।

শেয়ার করুন:

সাধুবাদ জানাই সাদিয়া নাসরিনকে। দুঃখজনক যে এমন নিচু শ্রেণীর পুরুষের সংখ্যা এই সমাজে অনেক। তাই লোকটি অনেক সমর্থকও পেয়ে গিয়েছিল রাস্তায়। এমন বৈরী পরিস্থিতিতে সাদিয়া নাসরিন হাল ছেড়ে দেননি, সাহসের সাথে লড়েছেন, জানোয়ারটাকে ধরাশায়ী করেছেন, তার সাথীদের পরাস্ত করেছেন প্রকাশ্য দিবালোকে। এমন আরো কিছু সুপুরুষ পত্রিকার পাতায় স্থান পেলে বাকিদের জন্য তা শিক্ষণীয় হবে।