নাহরীন: তুমি যখন খুব সরব জিপিএ ৫ এর ঐ ভাইরাল হওয়া খবর নিয়ে, তনু হত্যা অথবা স্ট্যানফোর্ডের ঐ ধর্ষিত মেয়েটির হৃদয়স্পর্শী চিঠি নিয়ে, ঠিক তখন আমি তোমার পাশেই দাঁড়িয়ে পুরান ঢাকার সুপ্রীম কোর্টের চারতলায় ১০/১২ ফিটের কামরায়, চোখে পড়েনি আমায়? পড়বেই বা কেমন করে! এতো ছোট প্রায় দুই শতাধিক মানুষে গিজগিজ এই ঘরটায় আমি-তুমি-আমরা দিয়ে গুমোট। এখনও বুঝতে পারলে না ঠিক কি বলছি!!! ঐ যে আমি পারিবারিক আদালতের কথা বলছি, ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি আমার প্রিয়তমেষু থেকে প্রতিপক্ষ হয়ে গেলে!
আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে, ওর হাতটা খুব শক্ত করে ধরা। জানো,কেন অমন শক্ত করে ধরেছি? আমি না ধরলে তুমি/তোমরা যে ওকে নিয়েই যাবে। শুধু হাত দিয়ে ধরেও কি অনেক মা পারে ঐ ছোট ছোট হাতগুলোকে আগলে রাখতে!!!
আমার শরীরের ভেতরে বেড়ে ওঠা ঐ যে আরেকটা শরীর, প্রতি সপ্তাহে বেড়ে ওঠা ঐ ছোট্ট মানুষটা, দুমাস গড়াতেই আমি যার হৃদস্পন্দন শুনেছি আমার হৃদয়ের গভীরে, আরও দুমাস গড়াতেই যে আমাকে আমার ভেতরে থেকেই ছুঁতে চাইতো, এমন করে নয় মাস যে আমার ভেতরেই বেড়ে উঠেছে আমার সবটা নিয়ে, সে আসলে আমার কেউ নয়।
রাষ্ট্র বলে আমি তার কাস্টওডিয়ান (Custodian), তার অভিভাবক নই। সে আমার সাথে থাকতে পারবে শুধু সাতটা বছর, কারণ তার জন্ম-সহায়ক বাবা আমার সাথে আর নেই। এই সম্পর্কের সামাজিক নামকরণ ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’। কী নির্মম এক রাষ্ট্র, আসলে রাষ্ট্র নয়, যেন এক যন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্র। আর এই যন্ত্রের এক লৈঙ্গিক পরিচয়ও আছে, ‘পুরুষতন্ত্র’ যার নাম।
তাই তো আজ আমার এখানে আসা, আসছি প্রায় দুই বছর ধরে। আমি কাঠগড়ায় দাঁড়াই; প্রিয়তমেষু পুরুষ, তোমার সামনে, তুমি আমায় “যাহা বলিব সত্য বলিব” শপথে বেঁধে দাও, আর অসত্য প্রশ্নবাণে আমাকে রক্তাক্ত করো।
তুমি জনসম্মুখে প্রমাণ করতে চাও কী কী আইনি ধারায় আমি এই সমাজের চোখে চরিত্রহীন, কারণ তোমার কাছে বিচ্ছেদ-প্রাপ্ত নারী মানেই চরিত্রহীন। এই জীবিত আমাকে পোস্টমর্টেম করো আদ্যোপান্ত। তোমার কাছে আমার শিক্ষা, আমার কর্মবহুল জীবন, এগুলো আমার সাফল্য নয়, বরং আমার বোহেমিয়ান জীবনের বহিঃপ্রকাশ। কর্মজীবী মা মানেই সন্তানের অনিবার্য অবহেলা। আর কর্মজীবী পিতা মানেই আদর্শ!!! বাহ, কি বিচিত্র বৈপরীত্য!!!আবার আমি যখন আটপৌরে গৃহিণী তোমার চোখে, তখনও আমি আমার সন্তানের জন্য নির্ভরশীল অভিভাবক নই।
তখন তুমি প্রমাণ করো আমার আর্থিক অসচ্ছলতা আমার সন্তানের জন্য অমঙ্গল। আর তা না পারলে তুমি আমাকে গৎবাঁধা সমাজের ভালোমানুষির ছাঁচে ফেলে বিচার করো। আদালতের ঘরভর্তি মানুষের সামনে আমাকে মানসিকভাবে বিবস্ত্র করো, আমাকে বহুগামী অথবা সমকামী বলে তোমার বাক্যবাণে বিদ্ধ করো। প্রিয়তমেষু পুরুষ, ধর্ষণ কি শুধু শরীর দিয়ে হয়? না,ধর্ষণ শব্দ দিয়েও হয়, যা তুমি প্রতি নিয়ত করে চল একাকী মাকে। ঐ কাঠগড়ার ভেতরে।
প্রিয়তমেষু পুরুষ, তোমার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ আমাকে বিচ্ছিন্ন করে সমাজ থেকে, ভালোবাসা থেকে, পুনরায় ভালবাসবার থেকে। আর আমার সাথে তোমার বিচ্ছেদ তোমাকে সংযুক্ত করে আরও অনেক সুন্দরের সাথে। বিচ্ছেদের একমাসের মধ্যেই তুমি নতুন জীবনসঙ্গী পাও। পুরনো সম্পর্ককে বাক্সবন্দি করে তুমি নতুনে আসক্ত হও। ফেইসবুকের প্রোফাইল পিকচারটা বদলে যায় নতুন যুগলছবিতে, রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসটা সিঙ্গেল থেকে আবার ম্যারেড হয়ে যায়। বছর ঘুরতেই তোমার নতুন সন্তানের ছবি দিয়ে তুমি পৃথিবীকে দেখিয়ে দাও “আমি সুখী”।
আর যে পুরাতন সন্তানের জন্য তুমি আমাকে আদালতে দাঁড় করাও, যদিও তার নাম হারিয়ে যায় তোমার ফেইসবুকের “লাইফ ইভেন্ট” থেকে। আমার সন্তান পুরনো হয়, বিস্মৃত হয়, অবহেলিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্র তোমাকে তবুও একমাত্র অভিভাবকই করে রাখে! আর আমি আমার বিচ্ছিন্ন জীবন আর দুটো কচি হাত শক্ত করে ধরে রাখি। আমি আর ভালবাসতে পারি না, আমার ফেইসবুক স্ট্যাটাসটা আজীবনের জন্য সিঙ্গেল হয়ে যায়, কারণ দ্বিতীয় বিয়ে করা মা তার সন্তানের কাস্টডির ন্যুনতম অধিকারটাকেও হারায় এই রাষ্ট্রে।
প্রিয়তমেষু পুরুষ, তুমি কি একবার আমাকে আমার চোখে দেখতে পারো না? জিপিএ ৫ পেয়ে সাধারণ প্রশ্নের উত্তর না পারা ছাত্রের জন্য তোমার যে প্রতিবাদ, ওদের অপারগতা পাবলিক করবার লজ্জায় তোমার যে লজ্জিত অবয়ব, কেন মুখগুলো ব্লার করা হলো না, এই দাবিতে তুমি যখন সংশ্লিষ্টদের ক্ষমা চাইতে বলো, সেই লজ্জাটা তুমি আজ কেন পাও না আমাকে এই শত শত মানুষের সামনে আদালতের কাঠগড়ায় দেখে, কেন রাষ্ট্রকে বাধ্য করো না আমাকে একটু ব্যক্তিগত করতে!!!
আমার ব্যক্তিগত জীবন যখন পাবলিক হয়, তোমার সাথে আমার “শোবার ঘরের” কথোপকথন যখন আদালতের আর্জিতে হয়, তখন কি তোমার একবার ইচ্ছা করে না এই রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাইতে বলতে আমার মুখটা ব্লার না করার জন্য? স্ট্যানফোর্ডের ধর্ষিত মেয়েটির মর্মস্পর্শী চিঠিটা তোমার ফেইসবুকের নিউজ ফিডে শেয়ার করার সময় আদালত পাড়ায় শব্দবানে ধর্ষিত হওয়া এই আমার চেহারা তোমার কি একবারও মনে পড়েনি, সত্যি কি পড়েনি?
প্রিয়তমেষু পুরুষ, শেষ বেলায় বলছি সম্পর্ক যেমন মানুষের মাঝেই হয়, বিচ্ছেদও কিন্তু মানুষে মানুষেই হয়। কিন্তু এই “লৈঙ্গিক রাষ্ট্রের” বিচ্ছেদ শুধু আমাদের ‘প্রিয়তমেষু’র প্রিয়টুকু তোমাকে দিয়ে, প্রিয় থেকে প্রিয়তর করে, আর আমাকে ‘তমেষু’ টুকুকে একটু বদলে ‘তমেশু’র তমশায় ঢেকে দেয়। আমরা কি আর একবার এই রাষ্ট্রে সন্তানের অধিকার, আর সম্মানের জায়গায় ‘প্রিয়তমেষু’ শব্দটার সমবন্টন করতে পারি না? সন্তান যদি আমাদের হয়,তবে সন্তানের অধিকার কেন লৈঙ্গিক হয়, বলো তো?
(জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লেখক একজন একাকী মা, যিনি প্রায় দুই বছরব্যাপী চলমান কাস্টডি কেইসের মামলার ভুক্তভোগী। লেখাটি পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে উপলক্ষ করে লেখা হলেও লেখক এই কেইস চলাকালীন অসাধারণ কিছু পুরুষের সহযোগিতা পেয়েছেন, যাদের কাছে তিনি আজীবন কৃতজ্ঞ)
সংযুক্তি:
file:///C:/Users/User/Downloads/Law-for-muslim-woman-in-Bangladesh_Bangladesh.pdf
Law for Muslim Women in Bangladesh (section 4 for guardianship law) by Sultana Kamal, Advocate Bangladesh Supreme court
Amio aky situation ar sikar hobo court a ja kotha bartay buzsi. Amr bacca oke ami kivabe sarbo amon akta manusher hate. ..amra ma ra sarajibon baccar jobs no kadbo
You will forget everything when You accept someone new, become mother of new baby…. This is the law of nature.
Nahrin Its just touches my heart. I am crying inside for my son. He is my child.He is part of my body. How can he belong to some one else ? How How why why …………..
Nice article
Please fix the link of the file from Adv. Sultana Kamal. Thank you.